নজরুল ইসলাম জুলু: জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা লেজ গুটিয়ে তাদের প্রভু রাষ্ট্র ভারতে পালিয়ে গেলেও, আওয়ামী লীগের লালিত-পালিত কর্মকর্তা ও আমলারা এখনো তাদের পদে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে এখনো কর্মরত এসব আওয়ামী লীগ অনুসারীদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।
বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশাসনে সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিধাভোগী’ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার ৬৮৩ জন। যা প্রফেসর ইউনুসের সরকারের জন্য রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তথ্যানুসারে, গত ১৫ বছরে প্রায় সব নিয়োগ দলীয় বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। তবে এর মধ্যে এমন কিছু লোক ঢুকে পড়েছেন, যারা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তারা নানা কায়দা-কানুন করে চাকরিতে ঢুকেছে, কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে সুযোগ পেয়েছে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে আওয়ামী লীগ ব্যতীত ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের লোকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস ও নন-ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের আগে তিন স্তরে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করা হতো।
নিয়োগের পূর্বে দুটি সংস্থাকে দিয়ে প্রার্থীর তথ্য যাচাই করা হতো। এরপরও সন্দেহ হলে জেলা প্রশাসন পুনরায় তদন্ত করত। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করলেও যদি কোনো প্রার্থীর বা তার পরিবারের বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যেত, তবে কোনো ছাড় দেওয়া হতো না।
সরকারি প্রশাসনে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের আধিপত্য
হাসিনার রাতের ভোটের কারিগর ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা এখনো বড় বড় পদে বহাল রয়েছেন। হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে প্রশাসনের বহু যোগ্য কর্মকর্তা বঞ্চিত ছিলেন, এবং এখনো তাদের ভাগ্য ফেরেনি। প্রশাসনের আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা নানা কৌশলে প্রশাসনকে গতিহীন করে রেখেছেন বলে মতামত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
একটি গবেষণা অনুসারে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ইউনুস সরকার প্রায় ৭০% কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। ডিসির পদায়ন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা, পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বঞ্চনা নিরসনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের উপদেষ্টারাও স্বীকার করেছেন, আমলারা সরকারকে অসহযোগিতা করছে। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পরও প্রশাসনের আওয়ামী মদদপুষ্ট রাঘববোয়ালদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতারা বারবার প্রশাসনকে আওয়ামী লীগের দোসরদের খপ্পর থেকে মুক্ত করার দাবি জানালেও সরকার এই বিষয়ে এখনো নিষ্ক্রিয়।
প্রশাসনে আওয়ামী অনুগতদের প্রভাব
জনপ্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রশাসন এখনো আওয়ামী সুবিধাভোগী আমলাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিগত ১৮ বছর ধরে বহু কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই পদবঞ্চিতদের মূল্যায়নের উদ্যোগ নিলেও, আওয়ামী আমলাদের নানা অপতৎপরতার ফলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।
জেলা প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রেও আওয়ামী আমলাদের প্রভাবই বেশি দেখা গেছে। প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের কারণে সরকারের কোনো কাজেই গতি নেই। হাসিনার সুবিধাভোগীরা প্রশাসনের অংশ হওয়ায় দেশের পতিত ফ্যাসিবাদীরা পুনর্বাসিত হচ্ছে। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
একটি সূত্র মতে, হাসিনার আমলের দুর্নীতির ফাইল গায়েব করে ফেলার জন্যই আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেছে।
এনবিআর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ে আওয়ামী আমলাদের আধিপত্য
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আওয়ামী লীগের অনুগতদের পদায়ন করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR)-এর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান একজন পরিচিত আওয়ামী সুবিধাভোগী। সম্প্রতি তার যোগসাজশে সরকারকে ‘ভ্যাট বিতর্কে’ ফেলে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া সরকার পরিবর্তনের পর ১৪ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় একের পর এক পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো এমন সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা বহাল রয়েছেন এবং আগের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন।
বিদেশে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা প্রশাসনের এবং বিএনপি-জামায়াতের সুবিধাবাদী নেতাদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছে। তারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিজেদের রক্ষা করতে বিদেশ থেকেই কোটি কোটি টাকা খরচ করছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, “প্রশাসন এখনো পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। যার ফলে অপরাধীদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এর পেছনে কোটি কোটি টাকার লেনদেন চলছে।”
পুলিশের একটি মহলও বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করতেই সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি-জামায়াতের কিছু সুবিধাভোগী নেতা প্রশাসনের ভেতরে থাকা পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। তবে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলছেন, “আমরা আওয়ামী দোসরদেরকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে চাই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকার পরিবর্তন ছাড়া কিছুই বদলায়নি। প্রশাসনের এই চিহ্নিত দোসরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সরকারকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে।
বিএ..