নাটোর প্রতিনিধি:
নাটোর জেনারেল হাসপাতালের সেবিকা ও অর্থব্যবস্থাপক মিতা খাতুন হত্যাকান্ডে প্রধান অভিযুক্ত আসামি আজিজ মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় আদালতে নিজেদের ভুল স্বীকার করে অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ ও তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মাসুদ রানা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। প্রথমবার এমন ভুল হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ ও নবীন তদন্ত কর্মকর্তা হওয়ায় উপ-পরিদর্শক মাসুদ রানা এমন ভুল করেছেন জানিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবদুর রহমান সরকার বরাবর লিখিত জানিয়েছেন তারা।
পাশাপাশি গত ২১শে নভেম্বর আজিজ মোল্লাকে অব্যাহতির সুপারিশ আমলে নেয়ার ব্যাখা চেয়ে তাকে ( সোমবার ২৭ শে জানুয়ারী ) পুলিশ হেফাজতে নিতে আদেশ দিলেও তা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় নাটোর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী জালাল উদ্দীন আহমেদকে আগামী ১১ই ফেব্রুয়ারী আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে কারণ দর্শনোর নোটিশ দিয়েছেন জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমান সরদার।
সোমবার (২৭শে জানুয়ারী) বিকেলে বিচারক ও তদন্ত কর্মকর্তার ব্যাখ্যা গ্রহণ করে এসব নির্দেশনা দেন জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমান সরদার।
ব্যাখ্যায় অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ বলেন, ‘অভিযুক্ত সাগর জমাদার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করলেও পরবর্তীতে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী রিট্রাকশানের আবেদন করেন যা নথিভুক্ত রয়েছে। রিট্রাকশান আবেদনে সাগর জানান, তাকে পাঁচ দিন অজ্ঞাতস্থানে আটক রেখে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ে বাধ্য করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। সাগর জমাদার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করলেও আসামী আজিজ মোল্লা নিজে কোনো দোষ দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেনি।’ ব্যাখ্যাদানের দায় থেকে অব্যাহতি চেয়ে বিচারক বলেন, ‘এজাহারে কোন আসামীর নাম না থাকায় তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে সন্দিগ্ধ আসামী আজিজ মোল্লাকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়ায় এবং এ ব্যাপারে এজাহারকারী ও কোর্ট পরিদর্শকের কোনরুপ আপত্তি না থাকায় সার্বিক বিবেচনায় সরল বিশ্বাসে আমি অভিযোগপত্র গ্রহন করি। প্রথমবার হওয়ায় নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের আদেশদানের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক থাকবো মর্মে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’
মামলার এজাহারে কোন আসামীর নাম না থাকায় মূল অভিযুক্ত আজিজ মোল্লাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে নিজের প্রতিবেদন ‘আপত্তিহীন’ করতে তদন্তকারী কর্মকর্তা মাসুদ রানা সেবিকা মিতার ভাই শেল্লাল প্রামাণিকের ১৬১ ধারার জবানবন্দী গ্রহন করলেও মিতার সাথে তার যোগাযোগ কম ও বসবাস দূরে ছিলো বলে ব্যাখায় স্বীকার করেন। ভাইয়ের অনাপত্তি তদন্তে প্রভাবিত করে না বলে ব্যাখ্যায় উল্লেখ করলেও তার উপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদন ‘আপত্তিহীন’ করতে ভূমিকা পালন করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
লিখিত ব্যাখ্যায় উপ-পরিদর্শক মাসুদ রানা বলেন, ‘একজন নির্দোষ ব্যক্তি যাতে সন্দেহপূর্ণভাবে বিচারে সোপর্দ না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আসামি আজিজ মোল্লাকে অব্যাহিত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যা তদন্ত তদারকি কর্মকর্তাগণও সমর্থন করেছেন। মামলার প্রারম্ভিক তদন্তকালে আদালতে প্রেরিত বিভিন্ন ফরোয়ার্ডিংয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমি যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছি তা বিচ্ছিন্নভাবে এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে। এমন অভিব্যক্তি অভিযোগপত্রের ক্ষেত্রে যে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ‘নবীন তদন্তকারী কর্মকর্তা’ হিসেবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছি। ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
নাটোর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী জালাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, তিনি আদালতের আদেশ এখনও হাতে পাননি। হাতে পেলে নির্দেশনা মাফিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তদন্তকার্যে পুলিশের ত্রুটি বিচ্যুতি বা গাফিলতি মাঝেমাঝে পরিলক্ষিত হলেও তা পর্যবেক্ষণ না করে সরল বিশ্বাসে অনুমোদনের ঘটনায় বিচারকের ক্ষমা প্রার্থনার ঘটনা বিরল ঘটনাটি খারাপ নজির হিসেবে চিহ্নিত থাকলো বলে মনে করছেন সিনিয়র আইনজীবীরা।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে আটটায় নাটোর জেনারেল হাসপাতালের সেবিকা মিতা খাতুনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কারও নাম উল্লেখ ছিল না। তদন্তকালে পুলিশ প্রথমে হাসপাতালের সুইপার সাগর জামাদার ও পরে মালিক আজিজ মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে। হাসপাতালের মালিককে সম্পৃক্ত করে সাগর ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। তবুও তদন্ত কর্মকর্তা মালিককে বাদ দিয়ে শুধু সাগরের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত বছরের ২০ নভেম্বর বিষয়টি আদালতের নজরে আসলে আদালত তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না-তার ব্যাখ্যা তলব করেন। একই সঙ্গে অব্যাহতির সুপারিশ কেন মঞ্জুর করা হয়েছে, সে ব্যাখ্যা দিতে নাটোরের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মামুনুর রশীদকে নির্দেশ দেন।
আর/এস