নাটোর প্রতিনিধি: স্ফুলিঙ্গ আর গর্জনে আকাশ থেকে ধেয়ে আসা ভয়ংকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই বজ্রপাত। নাটোরসহ সারাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন অন্তত: দুইশ’ মানুষ-যা বিশ্বের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ। প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে সমবেতদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং আর স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নাটোরে চলছে সমন্বিত প্রচারণা।
বিশ্বের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাত ঘটলেও এপ্রিল-মে মাস বেশী ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শীতের পরে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা উষ্ণ বায়ু এবং হিমালয় থেকে আসা শীতল বায়ুর সংমিশ্রণে তৈরী হয় বজ্র মেঘ। এই পরিবেশে মেঘের চলাচলে একটার সাথে অন্যটার ঘর্ষণে সৃষ্টি হয় বজ্র। মেঘ থেকে যে বজ্র মাটিতে আসে সেটাতে বজ্রপাত ঘটে। মাত্র ৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ডের আঘাতে বিপর্যস্ত হয় জনজীবন।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিধি অনেক বেড়েছে। অবস্থা বিবেচনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগসহ বজ্রপাতে হতাহতদের জন্যে দশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান প্রদান করছে। উত্তরবঙ্গের নওগাঁ ও পঞ্চগড়সহ দেশের আটটি স্থানে বজ্র নিরুপন সেন্সর স্থাপন করা হচ্ছে।
নাটোর জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এই কমিটি জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট বিতরণ করছে। এই লিফলেটে বলা হয়েছে, বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে পাঁকা বাড়ির নীচে আশ্রয় নেয়া, পানি,উঁচু গাছপালা, বিদ্যুৎ লাইন, খোলা ও উঁচু স্থান থেকে দূরে থাকা, বাড়িতে ধাতব বস্তু ও জানালা থেকে দূরে থাকা, বৈদ্যুতিক সকল ডিভাইসের সংযোগ বিছিন্ন করে ঐসবের সংস্পর্শে না আসা, সর্বোপরি বাড়ীতে যথাযথভাবে বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপন হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন এর নির্দেশনায় বজ্রপাতে নিরাপদ থাকার সচেতনতা বার্তার প্রচারনায় তৎপর হয়েছে জেলার বিভিন্ন দপ্তর। জেলা শিক্ষা অফিসার রমজান আলী আকন্দ জানান, মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ক্লাস শুরুর প্রাক্কালে সমাবেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে বজ্রপাত থেকে বাঁচার তথ্য জানানো হচ্ছে।
নাটোর ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স ষ্টেশনের উপ সহকারী পরিচালক আকতার হোসেন জানান, গত ছয়মাসে হাসপাতাল, শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সক্রিয় করা হয়েছে। বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার নিয়মাবলী সকল ইউনিয়নে মাইকিং করে জনসাধারণকে জানানো হয়েছে।
নাটোর জেলায় গত তিন বছরে বজ্রপাতে নিহত অন্তত: ১৯ জনের মৃত্যুকালীন অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে কৃষক ও দিনমজুর কৃষি জমিতে বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে দুইজন গৃহিনী আম বাগানে এবং একজন গৃহিনী ও একজন ছাত্রী বিলে মাছ শিকারের সময় নিহত হয়েছেন।
জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গত তিন বছরে জেলায় বজ্রপাতে নিহত ১৯ ব্যক্তির পরিবারকে মোট সোয়া তিন লক্ষ টাকার আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে। এসব পরিবারের অনেক সদস্যকে ভিজিএফ কার্ড প্রদানের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তাও প্রদান করা হয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পূণর্বাসন কর্মকর্তা মোঃ আলাউদ্দিন জানান, বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির বহুল প্রচারে কাজ করছে সকল উপজেলা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট কমিটি। যে কোন প্রশিক্ষণে দুর্যোগ মোকাবেলা সংক্রান্ত সেশনে নিয়মিত এসব তথ্য জানানো হচ্ছে। বর্তমানে আনসার সদস্যদের নির্বাচন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণে এসব তথ্য অবহিত করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, জনসাধারণকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে সচেতনতা বৃদ্ধি করলে মৃত্যুর হার বহুলাংশে কমানো সম্ভব। জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জেলার সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে কাজ করার জন্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ