মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী: তিনজন অপেক্ষা করছি কিভাবে নদী পার হবো।খেয়া নৌকা নদীর ওপারে।মাঝিকে দেখা যাচ্ছেনা।কয়েকবার গলা ঝেড়ে ডাক দিতেই মাঝি আমাদের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো।নদী পার হতে চাইলে বললো, এখন অনেক রাত।খেয়া ওপারে নেয়া যাবেনা।গাড়ী ঘোড়া থাকলে যাওয়া যেতো। আমরা উচ্চস্বরে বলতে লাগলাম,আমরা বিপদে পড়েছি।আমাদেরকে বাড়ীতে যেতেই হবে।মাঝি জিজ্ঞাসা করলো,তোমারা কোন গ্রামে যাবে।বললাম চৌপিনগর গ্রামে যাবো,আমরা মোন্না পাড়ায় যাবো। মামাদের নাম বলে পরিচয় দিলাম।তখন বললো, ওহ তোমরা হাছেন,লজি,খোকা,বাচ্চু ভাইদের ভাগিনা নাকি? বললাম, ঠিকই বলেছেন। ঠিক আছে তোমরা ওপারে থাকো,আমি আসছি।মাঝি খেয়া চালিয়ে এপারে চলে এসে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা ছোট মানুষ, এত রাতে কোথা থেকে আসলে?তোমাদের মামারা জানে,
তোমরা বাইরে আছো? না কেউ জানেনা।আসলে আমাদের কাল সকালে ফেরার কথা,কিন্তু শহরে দাদীর বাড়ীতে ভাল লাগেনি, তাই চলে এসেছি।গাড়ী পাচ্ছিলাম না।তাই দেরি হয়েছে। মাঝি আস্বস্ত হলো এবং বললো তোমরা খেয়াতে উঠে পড়। কিছুক্ষণ পর ওপারে পৌঁছে গেলাম।ভাড়া দিতে চাইলে বললো, তোমাদের ভাড়া দেয়া লাগবে না। মোন্নাপাড়ার তোমার মামারা যদি জানতে পারে আমি তাদের ভাগ্নের কাছে টাকা নিয়েছি, তাহলে আমাকে আস্ত রাখবেনা। আসলে ঐ তল্লাটে আমার নানার পরিবারের সকল সদস্যকে সবাই সমীহ করে চলতো।মামারা ঐ গ্রামের ভিতর সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী মানুষ। মামাদের পরিবারের
এতই জনবল ছিলো যে,চৌপিনগর গ্রামটি তাদের আত্বীয় স্বজন দিয়েই ভর্তি ছিলো। আর আমার বাবাকে গ্রামের লোকজন মোন্নাবাড়ীর জামায় হিসাবে সবাই চিনতো। ভালোই ভালোই নদী পার হলাম।গ্রামের মেঠোপথ ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে।সম্ভবত আমাবস্যা রাতের আধারে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না।বুকের ভিতর ভয় চেপে বসলো। এতটা পথ হেটে বাড়ী পৌঁছাতে গেলে এক ভৌতিক বট গাছ অতিক্রম করে যেতে হবে। গ্রামের প্রায়ই লোকজনের মুখে গল্প শুনেছি, সেই ভৌতিক পুরাতন বিশালাকৃতির বটগাছের কথা।গা শিরশির করছিল। তিনজনই সাহস বুকে বেধে অন্ধকার রাতের পথ হেটে হেটে ধীরে গতীতে
এগিয়ে যেতে থাকলাম।আর মনে মনে তিনজন আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম।বেশ অনেক্ষন হাটার পর সামনে পেয়ে গেলাম সেই ভৌতিক বটগাছ।ভয়ে হাটার গতি বেড়ে গেলো। তিনজন পরস্পরের হাতকে শক্ত করে ধরে এগুতে লাগলাম।বটগাছের সামনে এসেই ভো দৌড় শুরু করে দিলাম।একদমে বটগাছ দৌড়ে অতিক্রম করে কিছু দূর পার হয়ে দৌড় থামালাম এবং আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম আমাদের নিরাপদে বটগাছ অতিক্রম করায় সাহায্য করাতে।আরও ১০ মিনিট পথ হেটে নানীর বাড়ীতে পৌঁছে গেলাম।গিয়ে দেখি সবাই ঘুম কিন্তু দরজা খোলা আছে।সেই যুগেও মামাদের ভয়ে চোরে ঐ গ্রামে চুরি করার সাহস পেতো না। আমরা কাউকে কিছু না বলে,না ডেকে চুপিচুপি ঘড়ে প্রবেশ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে
পড়লাম। সকালে আমাদের ঘুম ভাংগার আগেই মা ও নানি আমাদের শিয়রে দাড়িয়ে আমাদের ডেকে জেগে তুললেন। ধমকের স্বরের বললেন, রাতে তোমরা কখন এসছো,কেন এত রাতে ফিরলে,দাদীর বাড়িতে থেকে গেলেনা কেন?ইত্যাদি নানা প্রশ্নের জবাবের মুখোমুখি হতে হলো। ঠান্ডা মাথায় জবাব দিলাম দাদীর বাড়ীতে ভাল লাগছিলো না তাই রাতেই রওনা করেছি।ভুলেও সিনামা দেখার কথা মুখে আনলাম না।কারণ ওটা জানতে পারলে,সবারই উত্তমমধ্যম খেতে নিশ্চিত। তাই বেমালুম মিথ্যা বলে কোন রকমে
নিজেদেরকে রক্ষা করলাম। মা ও নানি মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বললেন, এভাবে তোমাদের রাতে চলে আসা ঠিক হয়নি।রাতে পথে বিপদ হতে পারতো।ইত্যাদি ইত্যাদি। আমদের ডেকে দিয়ে মুখহাত ধুয়ে খাবার জন্য খাবার ঘরে আসতে বলে চলে গেলেন। তখনকার দিনে আজকের মত পেস্ট ব্যাবহার করা হতো না। দাতের মাজন হিসেবে ব্যাবহার হতো কয়লা,পোড়া পাটি,গাছের ডাল ইত্যাদি। কয়লা দিয়ে দাত মেজে সকালের খাবারের জন্য খাবারের ঘড়ে গেলাম। নানি মাটিতে মাদুর পেতে দিয়েছেন।এরপর পান্তাভাত,কাচামরিচ,আলু ভরতা,পেয়াজ দিয়ে সকালের নাস্তার কাজ সারলাম।এরপর সাত
মামার ছেলেমেয়েদের সাথে আড্ডা গল্পগুজব, খেলাধুলা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ ইচ্ছা হলো বড়শী দিয়ে পুকুরে মাছ মারবো।একটি বড়শী যোগার করে দিল মামাতো ভাই বাদশা।বড়শীতে কেচো গেথে পুকুরে ছিপ ফেলে মাছের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম।কিছুতেই মাছ টোপ গিলছিলো না।ধৈর্যের বাধ ভেংগে গেলো প্রায় দুপুর বেলা ঘুম ঘুম ভাব লাগছে।বড়শীটার গোড়া মাটির ভিতর শক্ত করে গেথে দিয়ে মাছ ধরার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বাইরের ঘড়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেই জানিনা। বাইরের ঘড় বলতে গ্রামে যা বোঝায় তা হচ্ছে। (চলবে)
মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী, সিনিঃ সহকারী পুলিশ সুপার