মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী: চাকুরী জীবনে বাবাকে দেখেছি জৌলুশপূর্ণ জীবনযাপন করতে।তিনি নিজেও টিপটিপ থাকতেন এবং আমাদেরকেও সেভাবে রাখতেন।দামি কাপড়, দামী জুতা,স্যুট-কোট, টাই ব্যাবহার করতেন।আমাদেরকেও দামি কাপড়, জুতা ইত্যাদি কিনে দিতেন।এক কাপড় কখনো দুদিন পড়তেন না।প্রতিদিনই এজন্য মাকে কাপড় ধুতে হতো।
তখন তো ওয়াশিং মেশিন ছিলোনা। মাঝেমধ্যে মা বাবাকে বলতেন অহেতুক এত টাকা পয়সা ব্যয় না করার জন্য। তখন বাবা বলতেন জীবনে অনেক কস্ট দেখেছি।কাপড়ের অভাবে তিন ভাই ভাগ করে কাপড় পড়েছি।সেন্ডেলের অভাবে খালিপায়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। একবেলা খেয়ে একবেলা না খেয়ে জীবনযাপন করেছি।দারিদ্র্যতা কি তা আমি কাছে থেকে দেখেছি।তাই আমি আর কস্ট করতে চাইনা এবং সন্তানদের কোন কস্ট পেতে দিতে চাইনা।
তুমি ধনী ঘড়ের মেয়ে কস্ট কি দেখনি এবং জানোনা।কারণ তুমি তোমার বাবা মা ভাইদের আদরে বড় হয়েছিলে।তাই আমার কস্ট তুমি বুঝবেনা। বেচে থাকতে বাবা সত্যিই আমাদেরকে অনেক অনেক ভাল রেখেছিলেন।কোন দিনই কষ্ট পেতে দেননি। আমাদের যত্ন নিয়েছিলেন।তাই সেই বাবাকে আজও ভুলতে পারিনা। বাবার শেষ জীবনে বাবার প্রতি আমিও যথেষ্ট যত্নবান ছিলাম।তার চিকিৎসা, ভরনপোষণ, চাহিদা সবই পুরুন করেছি।বাবা আমাকে,আমার স্ত্রী, সন্তানদেরকে অনেক অনেক ভালবাসতেন।
বৃদ্ধ বয়সেও আমার কোন ভুল বাবার চোখে পড়লে শাসন করতে ভুলতেন না।বাবাকে খুব ভয় পেতাম।রাগী মানুষ ছিলেন,কোন ভুল করে বসলে তখনই তিনি ধরে বসতেন এবং বোকাঝোকা করতেন আমার স্ত্রীর সামনেই।তিনি অধিকাংশ সময়ই আমার বাসাতেই থাকতেন।নাতি নাতনিকে নিজে পড়াতেন।স্কুলে আনানেয়াও করতেন।যখন যা প্রয়োজন হতো বাবা আমাকে না বলে আমার স্ত্রীকে জানিয়ে দিতেন।স্ত্রী আমাকে সাথে সাথে সেই চাহিদা পুরুন করার জন্য বলে দিতেন।বউমা ও শশুড়ের ভিতর সম্পর্ক এত গভীর ছিলো যে,মনে হতো তারা আপন বাবা মেয়ে।
আমার স্ত্রীর সাথে বাবা মাঝেমধ্যেই ইসলামিক জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে বিতর্ক করতেন। অনেক সময় বউমার কাছে পরাজিত হয়ে বউমার সিদ্ধান্তই সরল মনে মেনে নিতেন। বাবা মাঝেমধ্যে আমার ভাইবোনদের বলতেন,তোমারা কখনোই তোমার বড়ভাইকে অসন্মান করবেনা।আমি বাবা হয়ে তোমাদের জীবনে যা করতে পারিনি, সে তোমাদের জন্য তা করে দেখিয়েছে এবং তোমাদেরকে নিয়ে নিঃস্বার্থ ভাবে তোমাদের জন্য দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আমার জীবনেও আমি কখনোই বাবা মাকে অসন্মানিত করিনি।কখনো তাদের মনে আঘাত লাগে এমন কাজ করতাম না।
বাবা নিশ্চিত ছিলেন তার অনুপস্থিতিতে আমি ও আমার স্ত্রী কখনোই ভাইবোনদের পাশ থেকে সরে যাবোনা।সত্যিই আমি এত বয়সেও বাবার আস্থা ধরে রেখেছি। ঠিক বাবাও কোনদিন তার মা ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্ব পালনে শিথিলতা দেখাননি। দাদী বাবার উপর একটি জায়গায় বেশি অসন্তুষ্ট ছিলেন।সেটা হলো বাবা দাদীর অমতে আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন।
তাই দাদী শেষ জীবন প্রযন্ত মাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন নাই।তাই মা এবং দাদীর ভিতর সবসময়ই দুরত্ব বজায় থাকতো।এসব দেখে আমাদেরও খারাপ লাগতো কিন্তু করার কিছু ছিলোনা।কিছুটা প্রভাব যে আমাদের উপরে পড়েনি তাও নয়। বাবার প্রিয় ছাত্রী ছিলো আমার বড় মেয়ে। বড়মেয়ে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম,মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করে দিব।তখন বাংলাদেশে একমাত্র মহিলা ক্যাডেট কলেজ ছিল ময়মনসিংহ জেলায়।
এবার শুরু হলো নাতনীকে চান্স পাওয়ার উপযোগী করে তোলার।যখন মেয়েকে পড়াতে বসাতেন তখন দাদা নাতনীর সম্পর্ক ছিলো শ্রেফ শিক্ষক এবং ছাত্রীর।লিখাপড়া শেষে আবার দাদা নাতনীর সম্পর্ক স্বাভাবিক হতো। কঠোর শাসন,অধ্যাবসায়ের দ্বারা নাতনীকে পরীক্ষার উপযুক্ত করে তুললেন। সুনির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা হলো মেয়ে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করলো। দাদা তো ভিষণ খুশি।ক্যাডেট কলেজে প্রতিমাসে অভিভাবক দিবসে বাবা মাকে হাজির হয়ে সন্তানকে দেখার সুযোগ ছিলো।
পুলিশে চাকুরির কারণে আমি অনেক সময় যেতে পারতাম না।বাবা কিন্তু তার প্রিয় নাতনিকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতেন না।আমি রেন্ট এ কার থেকে গাড়ীভাড়া করে দিতাম তখন বাবা আমার স্ত্রী, আরেক কন্যা এবং পুত্র সহ বড় নাতনীর জন্য খাবার দাবার আয়োজন করে নিয়ে যেতেন এবং দেখা করে আসতেন। ক্যাডেটদের অন্যান্য অভিভাবকদের সাথেও এই সাত বছরে বাবার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।
যে সব ক্যাডেটদের পরিবার ঢাকায় থাকতো সেসব ক্যাডেটের অভিভাবকগনও বাবার সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য আমাদের বাসায় চলে আসতেন। বাবা এত মিশুক ছিলেন যে,অল্প সময়ের ভিতরই পরকে আপন করে নিতে পারতেন। এখন ভাবি বাবার একান্ত প্রচেষ্টা ছিলো বলেই আমার মেয়ে ক্যাডেটে ভর্তি হতে পেরেছিলো।মেয়ে আমার যখন ক্যাডেট থেকে পড়া শেষ করে বের হলো, সিদ্ধান্ত নিলাম এম বি বি এস এ পড়াবো। এখানেও এডমিশন টেস্টে দাদা ও মেয়ের মায়ের অবদান ছিলো অনেক বেশি।
বাবা নাতনিকে নিয়ে কোচিং এ যেতেন বসে থাকতেন, কোচিং শেষ হলে বাসায় নিয়ে আসতেন এবং পরদিনের পড়ার তদারকি করতেন।বাবা অসুস্থ থাকলে তখন আমার স্ত্রীকে সেসব দায়িত্ব পালন করতে হতো।কিন্তু নাতনী যখন সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলো তার তিন মাস আগে দাদা ইন্তেকাল করেন।নাতনীকে ডাক্তার হিসাবে দেখে যেতে পারলেন না।তবে বাবা, গোধুলী অর্থাৎ আমার মেয়েকে দেখিয়ে আমাদেরকে বলতেন,মেয়েটা ভবিষ্যৎ এর ডাক্তার তোমরা চিন্তা করোনা।হয়তোবা আমি গোধুলির গায়ে এপ্রোন পড়ে দেখে যেতে পারবনা। বাবার কথায় ঠিক হলো, মেয়ে গোধুলী যখন মেডিকেলে
চান্স পেলো তার কয়েক মাস আগেই বাবা চিরতরে আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। এখন গোধুলী ডাক্তার উপাধী পেতে যাচ্ছে আগামী ডিসেম্বর মাসে।মেয়ের বিয়েও হলো জামাই-ও এম বি বি এস( বিসিএস স্বাস্থ্য) ডাঃসাইদ ইবনে সুলতান।শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালে জামাই স্কিন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। একটি ফুটফুটে আমার নাতনীও হলো নুসাইবা বিনতে সাইদ।বয়স ১ বছর ২ মাসের মত। বাবা বেচে থাকলে নাতনী,নাত জামাই,নাতনীর সন্তানকে দেখে কতই না খুশি হতেন। (চলবে)
মোঃ মোস্তফা হারুন বরেন্দী, সিনিঃ সহকারী পুলিশ সুপার