রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগস্টিক সেন্টারের দালালরা। স্থানীয় কিছু দালালের কাছে জিম্মি হয়ে অনেকে দালালেল খপ্পড়ে পড়েছেন জেনেও মারধর খাওয়ার ভয়ে প্রতিবাদ করেন না। এ নিয়ে রোগী ও তার স্বজনদের মাঝে ব্যাপক রয়েছে। যদিও বর্তমান হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামিম ইয়াজদানীর তৎপরতায় দালালদের কার্র্যক্রম
কিছুটা কমে এসেছে। কিন্ত গোপনে গোপনে রামেক হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক, কর্মচারীর সহায়তায় দালালরা হাসপাতালের ওয়ার্ডে প্রবেশ করে রোগী ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক সময় দালালরা ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে গিয়ে হাসপাতাল প্রশাসনের অগোচরে ওয়ার্ড থেকে রোগী ধরে নিয়ে আসাসহ রোগীর রক্তের স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা হাসপাতালের
প্যাথলজিতে টেস্ট করার পরামর্শ দিলেও দালালরা তাদের বাহিরে নিয়ে গিয়ে বেশি টাকা নিয়ে নিচ্ছে। অথচ হাসপাতালে সেই টেস্টগুলো করতে কম টাকা লাগবে। গতকাল শনিবার এমনই এক ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নং ওয়ার্ডে। এ নিয়ে দালালরা ভুক্তভোগী শিশুর বাবা আলাউদ্দিনকে মারধর ও লাথি মারে। এছাড়াও অপর এক রোগী আবু নাইমকেও হুমকি-ধামকি দেয়। এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় হয় ও ভুক্তভোগী আলাউদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার (২৭ মে) দুপুরে সাইমন (ছদ্দনাম) নামের একব্যক্তি তার ৬ দিন বয়সি শিশুকে অসুস্থ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসেন। জরুরী বিভাগ থেকে ওই শিশুকে হাসপাতালের ২৬ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেয়। তারপর থেকে তারা ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গত শনিবার (২৮ মে) সকালে ২৬ নং ওয়ার্ডের সিনিয়র চিকিৎসকরা রাউন্ডে এসে তার শিশুর জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। সেগুলো হচ্ছে, আরবিএস, সিবিসি ও সিআরপি এবং অপর একটি পরীক্ষা। সবগুলো টেস্ট হাসপাতালের ভেতরে করার জন্য চিকিৎসক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজির ফরমে লিখে দেন।
এর কিছুক্ষণ পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজের গেটের বিপরীতে অবস্থিত লাইফ সাইন ল্যাব নামের একটি বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কর্মরত এক নারী এসে নিজেকে হাসপাতালের লোক পরিচয় দিয়ে তার ৬ দিন বয়সি শিশুর শরীর থেকে ২ টিউবে রক্ত নেন। এ সময় ভুক্তভোগী সাইমন তিনি হাসপাতালের কর্মচারী
কিনা জানতে চাইলে তিনি নিজেকে হাসপাতালের লোক বলে পরিচয় দেন এবং সবগুলো টেস্ট ভেতরে হবে বলে জানান। হাসপাতালের ভেতরে প্যাথলজিতে টেস্ট হবে বললেও তাকে বাইরের লাইফ সাইন ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর নাইম তার কাছে জানতে চান এখানে কেন নিয়ে এসেছেন তখন ওই নারী বলেন, হাসপাতালে হবে না। এখানেই সব টেস্ট করতে বলেন। এ সময় সাইমন তার এক বন্ধুকে ঘটনাস্থলে ডাকেন।
তার বন্ধু ঘটনাস্তলে এসে হাসপাতালের কথা বলে কেন তাকে বাইরে নিয়ে আসলো এমন প্রশ্ন করলে ওই নারী চড়াও হয়ে ২৬ নং ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসকের কথা বলেন। যে তাকে ডেকে স্যাম্পল নিতে বলেছে। ওই নারী আরো জানান, কোনো কথা বললে যেন সেই ডাক্তারকে বলা হয়।
এ সময় রাজশাহীর খড়খড়ি থেকে শিশু সন্তানকে নিয়ে আসা আলাউদ্দিনও অভিযোগ করে বলেন, একই পন্থায় মিথ্যে কথা বলে ওই নারী তাকে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে এসেছেন বলে জানান। এ কথা
বলার সাথে সাথে ওই ডায়াগনস্টিকে কর্মরত একব্যক্তি তাকে মারধর করে ও লাফি মেরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বের করে দেন। এরপর আলাউদ্দিন বের হয়ে যান। ঘটনার পর তিনি জানান, তাকে মিথ্যে কথা বলে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে আসা হয়। এখন তার বাড়ি যাওয়ার ভাড়া নেই। এদিকে, সাইমন তার শিশুর রক্তের স্যাম্পল ও টেস্টের কাগজপত্র চাইলে তার সাথে টালবাহানা করা হয়। তারা তাৎক্ষনিক সেই
কাগজপত্র না দিলে সাইমন ওয়ার্ডে এসে আবার সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে চাইলে ওয়ার্ডবয় নজরুল বলেন, মেডিপ্যাথে পরীক্ষা করান ওখানে আমাদের ওয়ার্ডের এক চিকিৎসকের শেয়ার আছে। নাহলে তিনি রিপোর্ট দেখবেন না। আর ওয়ার্ডের একজন কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে লাইফ সাইন ল্যাবে যাওয়ার জন্য বলেন। ওই চিকিৎসক বলেন, ওখানে গেলে কমে হয়ে যাবে। চিকিৎসক ও ওয়ার্ডবয়ের টানা হেচড়ার কারণে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েন ভুক্তভোগী সাইমন।
পরে সাইমন তার বন্ধুর সহযোগিতায় হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামিম ইয়াজদানীর সাথে দেখা করে সব কথা খুলে বলেন। এরপর হাসপাতালের পরিচালক ওয়ার্ডবয়কে তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ওয়ার্ডবয় সহজ স্বীকারোক্তি দেন, ২৬ নং ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক তাকে মেডিপ্যাথে রোগীকে টেস্টের জন্য পাঠাতে বলেন, এ জন্য তিনি বলেছেন।
হাসপাতালের পরিচালক সেই চিকিৎসকের সাথে কথা বলে এসব করতে নিষেধ করে দেন। যদিও ওই চিকিৎসক ওয়ার্ডবয়কে রোগী পাঠানোর কথা অস্বীকার করেন। কিন্ত ওয়ার্ডবয় তার কথায় স্থির ছিলেন। পরে পরিচালক লাইফ সাইন ল্যাবে টেস্টের জন্য পাঠাতে চাওয়া ডাক্তারকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন কিন্ত তাকে পাওয়া যায়নি। পরে পরিচালকের সহায়তায় ভুক্তভোগী রোগী লাইফ সাইন ল্যাব থেকে স্যাম্পল ও কাগজপত্র ফিরে পান এবং হাসপাতালের ল্যাবে টেস্ট করতে দেন।
ভুক্তভোগী সাইমন বলেন, আমাকে মিথ্যে কথা বলে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল এক নারী। পরে তার ডায়াগনস্টিকে গিয়ে আবার চড়াও হয়। পরিচালক স্যারের সহযোগিতায় আবার হাসপাতালে টেস্ট করতে পারি। শুধু এই ওয়ার্ডই নয় অন্যান্য ওয়ার্ড থেকেও একই কায়দায় রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দালালরা। রোগী ও স্বজনরা বলছেন, এতো নিরাপত্তার মধ্যেও কিভাবে দালালরা রোগী বাইরে নিয়ে যাচ্ছে তা মাথায় আসছেনা। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে সতর্ক করা হয়েছে। সবাইকে বলা হচ্ছে হাসপাতালের প্যাথলজিতে রোগী পাঠানোর জন্য। আগামী মাসের মধ্যে হাসপাতালেই দিন রাত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। তখন রোগীদের আর বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বেনা।
বিএ