দলমত নির্বিশেষে সকলের ঠিকানাই তাঁর সরকার নিশ্চিত করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করাই তাঁর দায়িত্ব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারো কাছে যদি খবর থাকে বাংলাদেশের একটি মানুষ ভূমিহীন বা গৃহহীন রয়েছে অবশ্যই আমাদের খবর দেবেন। দল মত নির্বিশেষে যেই গৃহহীন থাকবে আমরা তাদেরকেই ঘর করে দেব, ঠিকানা এবং জীবিকার ব্যবস্থা করে দেব।’
তিনি বলেন, ‘দল মতের ভিন্নতা থাকতে পারে তাতে কিছু এসে যায় না। দেশটাতো আমাদের। আর আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তার মানে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব আমার।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে সারাদেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে আরো ২৬ হাজার ২২৯টি ঘরসহ জমি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে বলেন, ‘দল-মত, আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও মানুষের বড় পরিচয় সে মানুষ এবং সেভাবেই তিনি মানুষকে বিবেচনা করেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, মানুষকে আমি মানুষ হিসেবেই দেখি এবং প্রত্যেকটি মানুষ সুন্দর ভাবে বাঁচবে সেটাই আমি চাই। আমার বাবার সেটাই শিক্ষা। যে কারণে এদেশের প্রত্যেকটি মানুষের আমি সুন্দর জীবন জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে চাই।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি এই ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের কাছে ঘরের দলিল ও চাবি হস্তান্তর করেন। পাশাপাশি, পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সবগুলো উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত উপজেলা হিসেবেও ঘোষণা দেন।
তাঁর সরকারের পদক্ষেপের ফলে পঞ্চগড় ও মাগুরা জেলার সবকটি উপজেলাসহ দেশের ৫২টি উপজেলা সম্পূর্ণ ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত হওয়ার সাফল্য তুলে ধরে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি, আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার প্রত্যেকটি উপজেলাকেই এভাবে ভূমিহীন গৃহহীন মুক্ত করতে পারবো। প্রত্যেকের একটি ঘর থাকবে, একটি স্থায়ী ঠিকানা থাকবে, একটি সুন্দর বাসস্থান থাকবে এবং তাঁরা সুন্দরভাবে বাঁচবে। আর ইনশা আল্লাহ সেটা আমরা করে ফেলতে পারবো বলেই বিশ্বাস করি।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ এবং এর সকল সহযোগী সংগঠনসহ সকল রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী, জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করেন নিজ নিজ গ্রামে বা এলাকায় কোন ভূমিহীন বা গৃহহীন রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখার আহ্বান জানান, সরকার তাদের ঘর নির্মাণ করে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্যই আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি, ঋণ দেওয়া হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই সুযোগ নিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবনটাকে আরো উন্নত করবেন এবং নিজেরাও ভূমি কিনে ঘর বাড়ি করার যোগ্যতা যেন অর্জন করতে পারেন সেটাও আমরা চাই।
কারো কাছে হাত পেতে নয়, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মর্যাদার সাথে যেন বেঁচে থাকতে পারেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এই সমাজটাকে আরো সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি গ্রামের মানুষ যেন সবধরণের নাগরিক সুবিধা পেতে পারেন সেটাই আমরা নিশ্চিত করতে চাই।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি পাঁচটি জেলার পাঁচটি স্থানের সাথে সংযুক্ত থেকে উপকারভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন।
স্থানগুলো হচ্ছে-লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলাধীন চরকলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্প, বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলাধীন গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্প, ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলাধীন চর ভেড়ামারা আশ্রয়ণ প্রকল্প, পঞ্চগড় জেলার পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন মহানপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প ও মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলাধীন জাঙ্গালিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প।
গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান প্রকল্পের উপর একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন এবং এর পরেই একটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ২১০টি পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রতিটি পরিবারকে ২ দশমিক ৫ একর করে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানের মাধ্যমে ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম সর্বপ্রথম শুরু করেন। এখন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এ ইউনিয়নে কলাকোপা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৫ দশমিক ১৫ একর অবৈধ দখল উদ্ধারকৃত জমিতে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত জেলে, ভিক্ষুক, বিধবা ও অসহায় ১ হাজার ৪২৫ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
পাশাপাশি, বাগেরগাটে সুন্দরবনের দস্যুতা ছেড়ে দেয়া ১৩ জন জলদস্যু পরিবারকে এবং পঞ্চগড়ে ৩৬টি ছিট মহলের ৩৪৯টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের জন্য উন্নত স্যানিটারি ল্যাট্রিন, বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে বলেও অনুষ্ঠানে জানান প্রধানমন্ত্রী।
যারা নতুন ঘর পেয়েছেন তাদের বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে ঘর, বাড়ি যা দিয়েছি সেগুলো রক্ষা করা, উন্নত করা এটা আপনাদেরই দায়িত্ব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারে আমরা এই তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে ২৬ হাজার ২২৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে স্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার যে ঠিকানা দিতে পারছি আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আর বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। পাশাপাশি, এই কাজের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদও জানান তিনি।
করোনা ভাইরাস মহামারীর মধ্যে অসহায় মানুষগুলোর জন্য ঘর নির্মাণে সম্পৃক্ত থাকায় বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং ছিন্নমূল মানুষগুলোরও ঠিকানা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এটা একটা মহৎ কাজ, মহৎ উদ্যোগ। কারণ, একটা ঘর পাওয়ার পর একটা মানুষের জীবনটা তো পাল্টে যায়। মানুষের মুখে যে হাসিটা এটাই তো সব থেকে বড় পাওয়া জীবনের। এর থেকে বড় কিছু আর হতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাচ্ছি আমাদের বাংলাদেশে শতভাগ ভূমিহীন-গৃহহীন পুনর্বাসন হবে। প্রত্যেকটা মানুষ তার ঠিকানা পাবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা বাস্তবায়ন করাই তাঁর লক্ষ্য, আর এজন্য জীবনে বার বার মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে পড়লেও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রহমতে তিনি প্রাণে রক্ষা পান বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বোধহয় সে জন্যই (জাতির পিতার উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা) আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। না হলে বারবার মৃত্যুকে আমি সামনে দেখেছি। কিন্তু, আমি কখনো ঘাবড়ে যাইনি বা ভয়ও পাইনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছি যেন এই দেশের মানুষকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে বাঁচার মতো একটা সুন্দর সমাজ দিতে পারি। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা জনগণের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা, স্কুলগুলোকে জাতীয়করণের পাশাপাশি প্রত্যেক জেলা-উপজেলায় স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় স্থাপন মাধ্যমে গণমানুষের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি। একইসঙ্গে মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল ও কারিগরি বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার দ্বার অবারিত করণের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং দেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়িত করতেও তাঁর সরকারের পদক্ষেপ সমূহের উল্লেখ করেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী করোনার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে কেন্দ্র করে আমেরিকার ও ইউরোপীয় দেশগুলোর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ করে সবাইকে মিতব্যয়ী ও সাশ্রয়ী হবার মাধ্যমে সংকট উত্তোরণে দেশবাসীর সহযোগিতার প্রত্যাশাও পূনর্ব্যক্ত করেন তিনি। সকলকে দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি কাজে লাগানোর মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বানও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, একদিকে করোনা আর একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আমেরিকা রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দিয়েছে, তার ফলে, আমাদের সার কিনতে সমস্যা হচ্ছে, খাদ্য কিনতে সমস্যা হচ্ছে এবং এ সমস্ত কারণেই আজকে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ^ব্যাপীই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে এবং উন্নত দেশগুলোতে পর্যন্ত খাদ্যের জন্য হাহাকার দেখা গিয়েছে।
তিনি বলেন, আজকে আমেরিকা বলেন, ইংল্যান্ড বলেন সবজায়গাতেই বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা হচ্ছে। পেট্রল ও ডিজেলসহ জ¦ালানি সাশ্রয় করার উদ্যোগ উন্নত দেশগুলোও নিয়েছে। স্পেন, পতুর্গালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দাবানলের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগও দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখনো আমাদের দেশটা ভালভাবে চালাতে পারছি। কিন্তু, আমাদের এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে এবং সকল প্রকার সতর্কতামূলক পদক্ষেপও আমরা নিয়েছি। তাই, সবাইকে বলবো বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে, পানি এবং জ¦ালানির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে, আপদকালীন সঞ্চয় সবাইকে বাড়াতে হবে। আর কোথাও এক ইঞ্চি জমিও যেন পড়ে না থাকে সেখানে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। ইনশাল্লাহ, তবেই আমরা যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করতে সমর্থ হবো।
শেখ হাসিনা বলেন, কোন জমি কেউ ফেলে রাখবেন না, একটা তরকারি গাছ বা মরিচ গাছ হলেও লাগান, কোন জলাধার কেউ ফেলে রাখবেন না। হাঁস-মুরগী গবাবি পশু প্রতিপালন থেকে শুরু করে সকলকেই যার যেভাবে সম্ভব তাঁকে সেভাবে উৎপাদনে সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানান তিনি। যেন আমরা নিজেরাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি এবং খাদ্যের জন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে না হয়।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ এবং এই দুর্যোগের সঙ্গেই আমাদের বসবাস উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বর্ষাকাল চলমান থাকায় আবারও যে কোন সময় বন্যা আসতে পারে সেজন্যও সতর্ক থাকতে হবে।
এরআগে বৃহত্তর সিলেট বিভাগে বন্যা মোকাবিলায় বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাঁর সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ মানুষের সংগঠন কাজেই মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই আমাদের কাজ। সুত্র-বাসস
বিএ/