খবর২৪ঘণ্টা.কম: সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মর্গে বিনা টাকায় ময়নাতদন্ত হওয়ার কথা। পাশাপাশি পুলিশ রেজ্যুলেশন অব বেঙ্গল বা পিআরবির প্রবিধি অনুযায়ী মর্গ থেকে মরদেহ হস্তান্তরের সময়েই পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি তুলে দিতে হবে।
সে অনুযায়ী মর্গেই লেখার কথা প্রতিবেদনটি। অবশ্য বাস্তবতার নিরিখে সরকারি নির্দেশনায় সে সময়টা বৃদ্ধি করে ২৪ ঘণ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু মর্গে অনুসন্ধান করে জানা গেল, টাকা ছাড়া মর্গ থেকে মরদেহ বের হয় না। ময়নাতদন্তে নানা খাত দেখিয়ে নিহতের স্বজনের কাছ থেকে দুই হাজার থেকে শুরু করে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
এজন্য কোনো রশিদ বা বৈধ কাগজও দেওয়া হয় না। অনুসন্ধানে এও দেখা গেল, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিধিটা পিআরবি আর সরকারি নির্দেশনাতেই আটকে আছে। কোনো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনই নির্ধারিত সময়ে দেওয়া হয় না। ঘণ্টা পার হয়ে দিন, মাস আর বছর চলে গেলেও বেশিরভাগ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায় না। মাসের পর মাস মর্গে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে থাকার আড়ালেও বিভিন্ন মর্গ অফিসে টাকার খেলার তথ্য পাওয়া গেছে।
ময়নাতদন্ত বিভাগের বিভিন্ন কর্মী সংশ্লিষ্ট মামলায় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এই টাকা নেন। নিহতের পরিবার এই টাকার উৎস হলেও অজ্ঞাতপরিচয়ে মরদেহের স্বজন না থাকায় আটকে থাকে সেসব ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন।
কোনো কোনো ঘটনায় মামলার চার্জশিট জমা নিয়ে সময়ের বাধ্যবাধকতা থাকায় পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার পকেটের টাকা খরচ করেই নিতে হয় এই প্রতিবেদন।
অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত আলোচিত হত্যাকাণ্ড বা হত্যাকাণ্ড বোঝা যায়- এমন ঘটনাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্রুতই পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যা বা অজ্ঞাতপরিচয়ে উদ্ধার মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মাস থেকে বছর পার হলেও তা আর তৈরি হয় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিলম্বের কারণে বদলে ফেলা হতে পারে মৃত্যুর আসল কারণ। ময়নাতদন্ত থেকে প্রতিবেদন দেওয়ার দীর্ঘ সময়ের ফাঁকে প্রভাবিত হতে পারেন চিকিৎসক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও।
বিভিন্ন সময়েই ভুক্তভোগীরা টাকার বিনিময়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে আসছেন।
পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পিআরবি বিধি অনুযায়ী ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহের সঙ্গে পুলিশ সদস্য বা কনস্টেবলের কাছে হস্তান্তর করা কার্বন কপিটিই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। কিন্তু বিস্তারিত রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলে তাতে বিলম্ব করা হয়।
এই বিলম্বের মধ্যেই ঘটতে পারে অঘটন। বিধি অনুযায়ী পোস্টমর্টেম রিপোর্ট একটিই। বিস্তারিত রিপোর্ট বলে আইনে বা বিধিতে কিছু নেই।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ময়নাতদন্ত-সংক্রান্ত সিআরপিসি ও পিআরবির ধারাগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে পরবর্তী সময়ে কোনো চাপ, ভয়ভীতি বা লোভের কাছে নতিস্বীকারের সুযোগ থাকে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও নিশ্চিত হয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সূত্রে জানা গেছে, তারা গবেষণা করে ময়নাতদন্তের ভুলের নানা কারণ দেখিয়েছেন। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের জন্য যথাযথ আর্থিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন। এই অর্থ বার্ষিক পুলিশ বাজেটে যুক্ত করার কথাও বলেছিলেন।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক হাসপাতাল থেকে মর্গ পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে মরদেহ আটকে টাকা নেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেল। হরিপুর ভাতুরিয়া এলাকার গৃহবধূ হাজেরা বেগমকে (২০) আত্মহত্যা করে মারা যান তিনি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হাজেরার মরদেহ গ্রামে নিতে হাসপাতালে বিভিন্ন রোগীর স্বজন মিলে তার বৃদ্ধ মা সালেহা বেগমের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেন। মরদেহ পরের দিন মর্গে পাঠায় পুলিশ। ময়নাতদন্ত করতে পুরো পাঁচ হাজার টাকাই মর্গে দিতে হয়েছে এই মায়ের।
হাজেরার একজন স্বজন মুক্তা আক্তারও ছিলেন মর্গে। তিনি বলছিলেন, লাশের গোসল, কাপড় আর কেনার কথা বলে মর্গের লোকজন এই টাকা নিয়েছে। আরো বেশি চাইলেও দর কষাকষি করে তা কমানো হয়েছে। তবে কোনো রশিদ তারা পাননি।
যেসব খাত দেখিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে-বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, কাপড় না কিনে পলিথিন কিনেছে যার মূল্য ২০০ টাকার বেশি লাগার কথা নয়। তাছাড়া মর্গে এই খাতে মরদেহের স্বজনের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই। এমনকি মরদেহের ময়নাতদন্তে মর্গে এক টাকাও খরচ হওয়ার কথা নয়।
মর্গে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, লাশকাটা ঘরের চিত্রই অভিন্ন। মর্গে চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে বাইরে থেকে এসে যারা কাজ করেন, লাশের স্বজনের আবেগকে জিম্মি করে বিভিন্ন খাতের নামে তারা এই টাকা হাতিয়ে নেন। এজন্য মর্গে রীতিমতো সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে।
বিভিন্ন থানার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশের পুলিশ ছাড়া আর কোনো স্বজন থাকে না। এজন্য প্রতিবেদন পেতে কারো তদবিরও থাকে না। কাউকে ‘খুশি’ করাতেও কেউ যায় না। এতে ময়নাতদন্ত হওয়ার পর বছর পার হলেও প্রতিবেদনটা আর তৈরি হয় না। মামলার তদন্তও এগোয় না।
টাকা নিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন উল্টে দেওয়া বা টাকা ছাড়া প্রতিবেদন না পাওয়ার অভিযোগ সরাসরি অস্বীকারও করেন ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালের আরএমও।
সিভিল সার্জন ডা: এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সব মানুষ তো লোভের ঊর্ধ্বে নয়। সেই লোভে পড়ার প্রস্তাবটা কারা দেয়, তা খুঁজে বের করা উচিত। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে ময়নাতদন্ত আটকে বা তথ্য ঘুরিয়ে দিয়ে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।
দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, হয়তো মেডিকেল কলেজগুলোতে এই সুযোগটা একেবারেই কম। কিন্তু মফস্বলের মর্গে নানা কারণে এমনটা হতে পারে। সেখানে প্রভাবিত হওয়ার যেমন পরিবেশ থাকে, তেমনি রক্তচক্ষুও উপেক্ষা করা যায় না। তাছাড়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চিকিৎসক আর পুলিশের মধ্যকার কাজ হলেও বাদী বা বিবাদী পক্ষও এসে প্রভাব দেখায়, লোভে ফেলার চেষ্টা করে। অনেক সময়ে খোদ তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাবও থাকে।
পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা: এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, টাকা দিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ঘুরিয়ে দেওয়া বা টাকার জন্য ময়নাতদন্ত আটকে রাখার অভিযোগটা তাদের সব সময়েই শুনতে হয়। কারণ একটা হত্যাকাণ্ডে বাদি এবং আসামি দুটি পক্ষ থাকে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন কিন্তু একজনের পক্ষে যায়। সে ক্ষেত্রে অপর পক্ষ নানা অভিযোগ করতেই পারে। এর পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৭২ ঘণ্টার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বছরের পর বছর ধরে মর্গে আটকে থাকার বিষয়ে দুই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞই অভিন্ন মত দিলেন। তারা জানান, মূলত জনবলের অভাবে এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কম থাকায় প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হয়। এ ছাড়া ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্যও আটকে থাকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন আগে দেওয়া হয়।
ঠাকুরগাঁওয়ের মর্গের দু’জন মর্গসহকারী (ডোম) নাম প্রকাশ না করে নিহত ব্যক্তির স্বজনের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তারা দাবি করেছেন, একটি লাশ কেটে সেলাই করে প্যাকেট করে দেন তারা। এজন্য স্বজনরা ‘খুশি’ হয়ে যে টাকা দেন, তাই তারা নেন। কেউ না দিলে চেয়ে নেন না, জোরাজুরিও করেন না।
আটকে আছে শত শত ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: পুলিশ সূত্রে জানায়, সাধারণত অপমৃত্যুর মামলাগুলোর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। এজন্য মামলার পুলিশি তদন্ত শেষ হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া যায় না। এর ফলে বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রতা এবং মামলার নিষ্পত্তিতেও সময় লাগে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, জেলায় বেশি সময় ধরে শতাধিকের উপরে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে।সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
খবর২৪ঘণ্টা, জেএন