খবর ২৪ ঘণ্টা, বিনোদন ডেস্ক: যে দেশে মেয়েদের ঋতুস্রাব হলে এখনও ফিসফিসানি শুরু হয়ে যায়, প্রকাশ্যে তা নিয়ে কথা উঠলে বেশিরভাগ লোক চুপ করে যায়, মন্দিরে কিংবা ঠাকুরঘরে ঢুকতে নিষেধ করা হয়, সে দেশে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবিতে যখন বিষয়টা স্থান পায়, তখন সেটা অবশ্যই সুখবর। বিশেষ করে, ছবিতে যখন প্রথম সারির অভিনেতারা অভিনয় করছেন, তখন বৃহত্তর দর্শকের কাছে পৌঁছনোর পথটাও কিন্তু বেশ সহজ হয়ে যায়।
‘প্যাডম্যান’এর গল্প সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। রিয়েল লাইফ হিরো অরুণাচলম মুরুগানন্থমের গল্প অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখেছেন আর বালকি। তবে কোয়মবত্তূরের গল্পকে মধ্যপ্রদেশে নিয়ে এসেছেন দর্শকের কথা ভেবেই। লক্ষ্মীকান্ত (অক্ষয় কুমার) একজন সাধারণ মেকানিক। সদ্য বিবাহিত স্ত্রী গায়ত্রীকে (রাধিকা আপ্টে) সে বড় ভালবাসে। স্ত্রীয়ের নানা রকম সমস্যা দূর করার জন্য সে নতুন নতুন জিনিস তৈরি করতে থাকে। যখন দেখে পিরিয়ডসের সময় স্ত্রী নোংরা কাপড় ব্যবহার করছে, খুবই চিন্তিত হয়ে দোকান থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট কিনে আনে সে। কিন্তু অত দামী জিনিস গায়ত্রী কিছুতেই ব্যবহার করতে রাজি না হওয়ায় নিজেই স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করে দেখাবে, ঠিক করে। তবে তার তৈরি স্যাম্পল ব্যবহার করার জন্য কোনও মেয়েই রাজি হয় না। বরং উল্টে সকলে তাকে পাগল ভাবা শুরু করে। বাধ্য হয়ে কসাইখানা থেকে রক্ত নিয়ে সেটা একটা ফুটবলের ব্লাডারের মধ্যে পুরে ধীরে ধীরে পাম্প করে নিজেই স্যাম্পল পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে বিষয়টা জানাজানি হওয়ায় তার মা, বোন, স্ত্রী সকলেই লজ্জায় তাকে ছেড়ে চলে যায়। বাধ্য হয়ে গ্রামছাড়া হয় লক্ষ্মী।
ছবির প্রথমার্ধের গল্প এটুকুই। সেটা অরুণাচলমের সত্যি ঘটনার কাছাকাছি হলেও, বড্ড দীর্ঘ মনে হতে পারে। কোনও সামাজিক বিষয় ছবি তৈরি করার একটা ঝুঁকি থাকে। সেটা চট করে সরকারি বিজ্ঞাপনের মতো মনে হতে পারে। বিশেষ করে প্রথমার্ধে, পিরিয়ডস যে এ দেশে কতা বড় ট্যাবু সেটা বোঝাতে বড্ড সময় নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটা বিষয় বহুবার স্পষ্ট কথায় বলে দর্শককে প্রায় পাখি-পড়ানোর মতো মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাধিক আপ্টের মুখে কতবার যে ‘শরম’ (লজ্জা) শব্দটা শোনা গিয়েছে তার যদি কেউ হিসেব রাখেন, তাহলেই বোঝা যাবে।
‘প্যাডম্যান’ ছবির একটি দৃশ্য।
তবে ছবির দ্বিতীয়ার্ধ অনেকেটাই টানটান। এখানে অবশ্য পরিচালক তাঁর ক্রিয়েটিভ লাইসেন্স ব্যবহার করেছেন। সোনম কপূরের চরিত্র ছবিতে এক এমবিএ পড়ুয়ার। যে লক্ষ্মীর প্রথম গ্রাহকও বটে। মোটা অঙ্কের চাকরি ছেড়ে সে লক্ষ্মীকে সাহায্য করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। মেয়েদের শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পাঠই পড়ায় না, তাদের স্বনির্ভর হয়ে ওঠার উৎসাহও দেয়। লক্ষ্মীর তৈরি সস্তার স্যানিটারি ন্যাপকিন মেশিন দিয়ে এই মেয়েরা নিজস্ব ইউনিট খোলে, দু’টাকায় প্যাড বিক্রি করে নিজেরাই যাতে রোজগার করতে পারে। সোনমের চরিত্রটা (পরি) নেহাতই পরিচালকের মস্তিষ্কপ্রসূত (ছবির শুরুতে ডিসক্লেমারে অবশ্য বলা হয়েছে যে অরুণাচলম সে অনুমতি দিয়েছিলেন)। তবে ছবির শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে লক্ষ্মী তার সাফল্যের কৃতিত্ব ভাগ করে নেয় একজন মেয়ের সঙ্গে, সেটা মূলধারার বলিউডে নতুন। নয়তো বেশিরভাগ ছবিতে নায়কেরই সুপারপাওয়ারে সব সমস্যার সমাধান হয়। যেমন ‘টয়লেট:এক প্রেম কথা’য় হয়েছিল।
চিত্রনাট্যে বেশ কিছু জায়গায় ফাঁক রয়েছে। যেমন প্রথমার্ধের দৈর্ঘ্য। কিংবা সময়-কালের অসংলগ্নতা। বাস্তবে স্যানিটারি ন্যাপকিনে তুলোর বদলে যে সেলুলোজ ব্যবহার করা হয়, সেটা জানতে অরুণাচলমের দু’বছর লেগে গিয়েছিল। তারপর বেশ কিছু বছর তিনি গবেষণা করেন। ২০১৪ সালে একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পত্রিকায় বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের তালিকায় তাঁর নাম যোগ হয়েছিল। এবং ২০১৬ সালে তিনি পদ্মশ্রী পান। ছবিতে ঠিক বোঝা যায় না কতটা সময় কাটছে। কাটলেও বয়সের ছাপ কোনও চরিত্রেই পড়ে না। তবে যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি হবে সেটা হল, ছবির ট্রিটমেন্ট হঠাৎ হঠাৎ বদলে যাওয়া! হয়তো সেটা করা বিভিন্ন শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখেই। প্রথমার্ধে ছবির প্রেক্ষাপট গ্রামীণ ভারতবর্ষ। দ্বিতীয়ার্ধে দক্ষিণ দিল্লির সোনম কপূর ঢুকে পড়েন চিত্রনাট্যে। তাই ‘মাসিক’ নিয়ে আলোচনা শিফ্ট করে ‘চাম্স’এ। যদিও পরি এবং তাঁর বাবার কথোপকথন শুনতে ভালই লাগে। না লাগারও কারণ নেই। আরবান ছবিতে যে বালকি পারদর্শী! মনে পড়ে যাবে ‘চিনি কম’এর সহজ সংলাপগুলো। কিন্তু বাকি ছবির সঙ্গে সেগুলো মেলানো যাবে না। আম-আদমিকে বলিউড হিরো করে তুলতে গেলে কিছু বাড়তি ধাক্কা প্রয়োজন হয়। সেটা করতে গিয়েও চিত্রনাট্য কোনও কোনও জায়গায় ধাক্কা খেয়েছে। লক্ষ্মীর কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য টেনে আনতে হয়েছে অমিতাভ বচ্চনকে! শেষের দিকে লক্ষ্মী এবং পরির মধ্যে রোমান্টিক আঙ্গিকও যেন খানিক আরোপিত। অত হঠকারিতা করে সেটা একটা চুম্বন দিয়ে না বুঝিয়ে আরেকটু স্ক্রিনটাইম দেওয়াই যেত।
রাধিকা আপ্টে চরিত্রটার সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারবেন এ দেশের বহু মেয়ে। তাই অভিনয়ের তেমন সুযোগ না থাকলেও, নিজ ভূমিকায় রাধিকা যথেষ্ট সাবলীল। চিত্রনাট্যে সোনম কপূর আসার পর থেকে গল্পের গতি ফিরে আসে। তাই তিনি যে পরির ভূমিকায় ভালই অভিনয় করেছেন, সেটা বলাই যায়।
তবে ছবির সেরা প্রাপ্তি অক্ষয় কুমার। চিত্রনাট্য হোঁচট খেলেও তিনি কোথাও খাননি। মাপা অভিনয়টা রপ্ত করে ফেলেছেন তিনি। বলিউড সুপারস্টার হয়েও কমফর্ট জোনে বাইরে বেরনোর সাহসটা দেখাচ্ছেন তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই। কিন্তু এবার নিজের সেরাটা দিয়েছেন অক্ষয়। তাঁর সমসাময়িকরা যখন লাভস্টোরিতে মাতছেন এখনও, কিংবা সুপার স্পাইয়ের ভূমিকায় পরদায় নিজেদের ‘সোয়্যাগ’ মেনটেন করছেন, সেখানে তিনি অনায়াশে মেয়েদের প্যান্টি পরে নিচ্ছেন! ঋতুস্রাব নিয়ে যাবতীয় মিথ ভাঙছেন স্বল্প হিউমারের সঙ্গে। কোনও সময়ই তাঁকে সুপারস্টার অক্ষয় কুমার লক্ষ্মীকে ছাপিয়ে যায়নি। আশা করা যায়, তাঁর টানেই হল’এ এ ছবি দেখতে বেশি সংখ্যক দর্শক যাবেন। কারণ ছবি পারফেক্ট না হলেও, বিষয়টা বড্ড জরুরি।
খবর ২৪ ঘণ্টা.কম/ জন