রাজশাহীতে গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য গ্রাম কিন্তু এক বৃদ্ধাকে তাঁর সৎকারের জন্য কোন লোক মিলেনি। শেষে পুলিশ অভয় দিল, বৃদ্ধাকে সৎকারের দিন গ্রামে কোনো পুলিশ যাবে না। তাও সৎকার কাজের জন্য কেউ আসেনি। অন্য গ্রামের লোকজন এসে মালঞ্চ রায় নামের ওই বৃদ্ধার মরদেহ দাফন করেছে। গত ৭ নভেম্বর রোববার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রামপাড়া গ্রামের চিত্র ছিলো এমনই। গত ৪ নভেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য গ্রামটি । ভয়ে রাতে বাড়িতে কোন নারীও থাকছেন না। রামপাড়া গ্রামটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা।
গ্রামটিতে ৩৬টি পরিবার। এরমধ্যে মাত্র চারটি পরিবার মুসলিম। গ্রামের বাসিন্দা আনন্দ রায় চোলাই মদ তৈরি করে পান করেন। একবার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল। জামিন নেওয়ার পর আর আদালতে হাজিরা দেননি তিনি। তাই আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত ৪ নভেম্বর শুক্রবার দুপুরের পর পুলিশ বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেলে। তখন গ্রামবাসী পুলিশের ওপর হামলা করে তাঁকে ছিনিয়ে নেয়।
থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মনিরুল ইসলাম ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মাসুদুর রহমানকে মারধরের পর অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে। গ্রেপ্তার করা হয় সাতজনকে। তবে আনন্দকে আর পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় পুলিশ মোট ১৬ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও ৪০-৫০ জনকে আসামি করে মামলা করে। মারধরের শিকার এসআই মনিরুল এ মামলার বাদী।
পুলিশ এখন এ মামলায় ধরপাকড় চালাচ্ছে। শুধু রামপাড়া নয়, আশপাশের কয়েকটি গ্রামে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তল্লাশির নামে বাড়িঘরে হামলা, আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল ভাঙচুর, এমনকি একটি বাড়ির টিউবওয়েলের হাতল খুলে নিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। রামপাড়ায় গত ৫ নভেম্বর শনিবার রাতে বাড়িতে মারা যান ৮০ বছরের বৃদ্ধা মালঞ্চ।
গ্রামের লোকজন বলছেন, ওই রাতেও গ্রামে পুলিশ এসেছিল। মালঞ্চ রায় ছাড়াও আরো কয়েকজনের বাড়ি তছনছ করা হয়েছে। বাড়ির দরজা-জানালা ভাঙচুর করা হয়েছে।
ভোররাতে মালঞ্চ মারা যান। তাঁর ছেলে সচীন রায় ও নাতি চয়ন রায় গত ৪ নভেম্বর শুক্রবার থেকে পালিয়ে আছেন। মালঞ্চ মারা গেলেও তাঁরা আসেননি। খবর পেয়ে সেখানে যান জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলার সভাপতি বিমল চন্দ্র রাজোয়াড়। তিনিই পুলিশের সঙ্গে কথা বলে অভয় নেন। তাও গ্রামের কোন পুরুষ ফিরে আসেননি। তাই অন্য গ্রামের লোককে ডেকে মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। পার্শ্ববর্তী দেবপুর গ্রামের পুরান পুস্কুরনি এলাকায় দুপুরের পর মালঞ্চ রায়কে দাফন করা হয়।
দাফনের সময় ১০-১৫ জন পুরুষ মানুষকে দেখা গেছে। তারা সবাই অন্য গ্রাম থেকে এসেছিলেন। সানাদিঘি গ্রামের সুরেশ রায়, দেবপুর গ্রামের সন্তোষ রায়, কামাড়পাড়া গ্রামের টুটন সিংহ, রাজারামপুর গ্রামের অজিত মুন্ডা, অভয়া গোপালপুর গ্রামের সুশীল কুমারসহ অন্যরা জানালেন, আদিবাসী নেতা বিমল চন্দ্র রাজোয়াড়ের ডাকে তাঁরা এসেছেন। সচীন রায়ের স্ত্রী শিখা রায় বলেন, গত শুক্রবার রাতে পুলিশ এসে তাদের ঘরের দরজা, বাথরুমের দরজা ও হাঁড়িপাতিল ভাঙচুর করে গেছে। তার শাশুড়ি মারা গেলেও তার স্বামী মাকে দাফন করার জন্য বাড়িতে আসতে পারেননি।
তার ছেলেও আসতে পারেনি। তাদের আত্মাীয় স্বজন ও পাশের গ্রামের লোকজন এসে দুপুরের পর লাশ দাফন করতে নিয়ে যায়। মাদক মামলার আসামি আনন্দ রায়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, কেউ নেই। বাড়ির একটি দরজায় তালা, আরেকটি ভাঙা। পাশের বাড়ির বাসিন্দা নীলা বেওয়া (৬৫) জানালেন, ঘটনার সময় তাঁর ছেলেরা বাড়িতে ছিল না। তাও পুলিশ তাঁদের ধরতে আসে। না
পেয়ে ঘরের জানালা-দরজা, চুলা, হাঁড়িপাতিল সব ভেঙে দিয়ে গেছে। বাড়ির বাইরের টিউবওয়েলের হাতলটাও খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নীলা বলেন, জমির ধান পেকে গেছে। এখন ধান কাটার মতোও বাড়িতে কেউ নেই। তিনি কী করবেন তা বুঝতে পারছেন না। আদিবাসী পরিষদের নেতা বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় বলেন, ‘পুলিশ আনন্দকে ধরতে এসেছিল সাদাপোশাকে। সে কারণেই গ্রামবাসী মনে করেছে অন্য কেউ আনন্দকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আর এ জন্যই সাদা পোশাকের পুলিশকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল।
দু’একজন গায়ে হাতও তুলেছিল। এটা ভুল বোঝাবোঝি। তাও আমরা বলছি, যাঁরা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, শুধু তাঁদেরই আইনের আওতায় আনা হোক। অন্য কাউকে যেন হয়রানি করা না হয়।’ গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘অন্য কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। যাঁরা জড়িত ছিল, শুধু তাঁদেরকেই খোঁজা হচ্ছে। হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ সঠিক নয়।’ ওসি বলেন, ‘গ্রামের এক বৃদ্ধা মারা যাওয়ায় আদিবাসী নেতা আর আওয়ামী লীগের নেতাদের অনুরোধের কারণে আমরা বলেছি, আজ গ্রামে কোন পুলিশ যাবে না। তাও যদি ভয়ে কেউ গ্রামে না আসে তাহলে আমরা কি করতে পারি।