ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসবে মেতেছে নওগাঁর মহাদেবপুরসহ সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। উৎসবমুখর পরিবেশে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদৃ নৃ গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাসী কারাম উৎসব উপলক্ষে গত রবিবার মহাদেবপুর উপজেলার ঐতিহাসিক ডাকবাংলো মাঠে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিলন মেলা বসে। এ মিলন মেলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭৫টি সাংস্কৃতিক দল অংশগ্রহণ করে।
এসব সাংস্কৃতিক দলের ঐতিহ্যবাহী নাচ গানে মুখরিত হয়ে উঠে ডাকবাংলো মাঠ। বিকেলে এ উপলক্ষে আলোচনা সভা ও অংশ্রগ্রহণকারী দলগুলোর মাঝে পুরুষ্কার বিতরণ করা হয়। কারাম উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি নরেন পাহানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রবিন্দ্রনাথ সরেন, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর নেতা বিভূতি ভূষন, নকুল কুমার পাহান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন মুকুল, শহিদ হাসান সিদ্দিকী স্বপন, আজাদুল ইসলাম আজাদ প্রমুখ।
এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সমস্যা ও সংকটে পাশে থেকে সংবাদ পরিবেশনের জন্য ৬ জন সাংবাদিককে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। তাঁরা হলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন দিলু, দৈনিক জনকণ্ঠের রাজশাহী প্রতিনিধি সৌরভ জাহাঙ্গীর, চ্যানেল আইয়ের নওগাঁ প্রতিনিধি ইমরুল কায়েস, যমুনা টেলিভিশনের নিজস্ব প্রতিবেদক শফিক ছোটন, দৈনিক ইত্তেফাকের মহাদেবপুর উপজেলা সংবাদদাতা আজাদুল ইসলাম ও দৈনিক করতোয়ার পত্নীতলা উপজেলা প্রতিনিধি বুলবুল চৌধুরী।
অন্যদিকে গত শনিবার নজিপুর পাবলিক মাঠে বেসরকারি উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংস্থা কারিতাস ও এসআইএল এর সহযোগিতায় আদিবাসী সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে নজিপুর পাবলিক মাঠে ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
এ উপলক্ষে নজিপুর পাবলিক মাঠে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি আলহাজ্বশহিদ্জ্জুামান সরকার বাবলু এমপি। কারাম উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি যতিন টপ্যর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আজাদুল ইসলাম আজাদ ও কারিতাসের ডিএম দিপক এক্কা, মাঠ কর্মকর্তা হোসান্না হাসদা, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর নেতা সুধীর তির্কি, বাবুলাল, লুইস সরেন কারাম উৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইগ্রেসিউস আনন্দ প্রমূখ। এ অনুষ্ঠানে নওগাঁর মহাদেবপুর, বদলগাছী, সাপাহার, পোরশা, পত্নীতলাসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৭০টি সাংস্কৃতিক দল অংশগ্রহণ করে এবং তাদের নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য তুলে ধরে দলবদ্ধভাবে নৃত্য পরিবেশন করে। পরে নৃত্য পরিবেশকারী দলগুলোর মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
অপরদিকে গত রবিবার ঐতিহাসিক নাটশাল ও বনগ্রামেও উৎসব মুখর পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। নাটশাল মাঠে অনুষ্ঠিত কারাম উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নওগাঁ-৩ মহাদেবপুর-বদলগাছী আসনের সাংসদ আলহাজ্ব মোঃ ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম। বনগ্রাম মাঠে আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্র ও কারাম উৎসব উদযাপন কমিটি আয়োজিত কারাম উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী বকু।
নন্দলাল উরাও এর সভাপতিত্বে ও দিপঙ্কর লাকড়ার সঞ্চালনায় এ উৎসবে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলর বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম ও ড. রতন কুমার। ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব উপলক্ষে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর পল্লী গুলোতে বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। সমতলের ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী কৃষি জমিতে কঠোর পরিশ্রমের পর একটু অবসর পেলেই মেতে ওঠে নানা সামাজিক উৎসবে।
কারাম পূজা বা ডাল পূজা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস মতে কারাম পূজা করা হয় মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা ও পরিবারের মঙ্গলের জন্য। রোপা আমন লাগানোর পর অবসর সময়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন পূজা অর্চনা ও দলবেধে নাচ-গান করে কারাম উৎসব পালন করেন। ভাদ্র মাসের চাঁদের ১০ দিন পর কারাম পূজা করা হয়ে থাকে। অনেকে আবার এই চাঁদের পূর্ণিমাতে এই উৎসব পালন করেন।
আবার কেউ কেউ আশ্বিন মাসের একাদশীতে এই উৎসব পালন করে থাকেন। স্থান ও গোত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন তিথিতে এই উৎসব পালন করা হলেও কারাম পূূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা প্রায় অভিন্ন। পূজার ৬ দিন আগে থেকে কারমা দেবতার নামে গ্রামের সকল নারী-পুরুষ একত্রে ঝুমের নাচ গান করে।
কারাম পূজার প্রচলন নিয়ে এক বিশাল লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সেই প্রচলিত লোককাহিনী মতে, কারমা ও ধারমা নামের দুই ভাই ছিল। এক দিন ধারমা বললো ‘‘ভাই কারমা চল আমরা আমাদের কর্ম কপালের জন্য, সংসারের উন্নতির জন্য কারাম গোসাই এর পূজা করি। কিন্তু কারমা সে কথা অবজ্ঞা করে চলে গেল। ধারমা তখন একাই কারাম গোসাইয়ের পূজার আয়োজন করলো। বোনদের দাওয়াত করলো, বোনরা এসে উপবাস থেকে জাওয়া জাগাতে (বিভিন্ন ধরনের রবিশস্যের ধান গজাতে) আরম্ভ করলো। এমন সময় কারমা এসে জাওয়া জাগানো ডালিটি ফেলে দিল এবং পূজার সমস্ত আয়োজন লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে বললো এখানে কোন কারাম গোসাইয়ের পূজা হবে না।
এর পর কারমার কপালে নেমে এলো চরম দুর্দশা । খাবার গেলে ভাতের দানা হারিয়ে যায়, মাঠে গেলে শস্য থাকে না এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায় কারমা। তার এ দুর্ভাগ্য জানার জন্য এক পন্ডিতের কাছে গেল কারমা। পন্ডিত সব শুনে বললো কারাম গোসাইকে অবহেলা ও অপমান করার জন্যই তার এ হাল হয়েছে। এ কথা শোনার পর কারমা অনুতপ্ত হয় এবং নিজের ভ‚ল বুঝতে পেরে কারাম গোসাইয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তার পূজা অর্চনা করে। এ পূজা অর্চনার মধ্য দিয়ে কারমা তার কর্ম কপাল পুনরায় ফিরিয়ে আনে।
আর এই কারমার নাম অনুসারে এই উৎসবকে কারমা বা কারাম উৎসব বলা হয়। সেই থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজের কর্মকপাল নিয়ে সুখে থাকার প্রত্যয়ে কারাম উৎসব পালন করে আসছে।
বিএ/