প্রায় পাঁচ শতাব্দির ইতিহাসে এই প্রথম ভক্তদের সমাবেশ হচ্ছে না রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী খেতুরী ধামে। যুগ যুগ ধরে দুর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার মহান সাধক ঠাকুর নরোত্তম দাসের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে বছরে একবার মিলিত হয়ে থাকেন।
তিন দিনের এ মহোৎসবে প্রতি বছর যোগ দেন দেশ-বিদেশের প্রায় ২০ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী। তবে এবার করোনা মহামারীর কারণে ভক্তদের এই সমাবেশ হচ্ছে না। বুধবার সকালে রাজশাহী নগরীর একটি রেস্তোরাঁয় শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ড একটি সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর ড. মদন মোহন দে বলেন, প্রতিবছর শ্রী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে প্রেমভক্তি মহারাজ ঠাকুর শ্রীল নরোত্তম দাস মহাশয়ের তিরোভাব তিথি মহোৎসব পালিত হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ ঝুঁকির কারণে আগামী ৪ থেকে ৬ নভেম্বর গোদাগাড়ীর খেতুরে এবার ভক্ত সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য এই যে, কয়েক লাখ ভক্তদের সমাগম হলে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে চাই না, আবার কারও অকাল মৃত্যুও চাই না। মহোৎসব হওয়ার পর এলাকাবাসীর যদি কারও করোনা সংক্রমণ দেখা দেয় তাহলে তার জন্য আমাদের দিকেই আঙ্গুল তোলার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না।
আবেগ-তাড়িত না হয়ে জীবন রক্ষা করাই বড় ধর্ম উল্লেখ করে ড. মদন মোহন দে বলেন, জীবন থাকলে ধর্মকর্ম এবং ভজন সাধন করা যাবে। তাই যতদিন পর্যন্ত করোনা ভ্যাকসিন সাধারণ মানুষের মানুষের নাগালে না পৌঁছাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমরা আবেগ-তাড়িত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ভক্ত সমাগম না ঘটানোর পক্ষে। এলাকাবাসী এবং দেশবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ভক্ত সমাগম না হলেও তিরোভাব তিথি মহোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। মন্দিরের ফটক বন্ধ করে তাদের নির্ধারিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হবে। নাগমন্দিরে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী কীর্তন করা হবে। এতে চারটি দল অংশ নেবে। প্রতি দলে থাকবেন মাত্র ১০ জন। রান্নাবান্নার জন্য আরও ১০ জন থাকবেন। এছাড়া ট্রাস্ট বোর্ডের ১২ জন সদস্য এবং অন্যান্য ছয়জন কর্মী থাকবেন। সবমিলিয়ে ৭০ জনের মতো অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। এর বাইরে একজনও সুযোগ পাবেন না। মন্দিরের ফটক বন্ধ রাখা হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে ট্রাস্ট বোর্ডের কথা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন নির্ধারিত সময় খেতুরীধামের দিকে কোন ভক্তকে যেতে দেবে না। মহাসড়কে বাস এলে ঘুরিয়ে দেয়া হবে। উৎসবের সময় প্রতিবছরের মতো এবার কোন মেলা হবে না। দোকানপাট বসবে না। তাই ট্রাস্ট বোর্ডের পক্ষ থেকে ভক্তদের এবার খেতুরী ধামে না আসার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক শ্যামাপদ স্যানাল, সদস্য সুনন্দন দাস রতন, বাবু মÐল, গণেশ চন্দ্র ঘোষ, বিকাশ কুমার সরকার, ব্যবস্থাপক গোবিন্দ চন্দ্র পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত বর্তমান রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা তীরের গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব পার করে ঠাকুর নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে নিখিল বৈষ্ণবকুল লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি খেতুরে ফিরে আসেন। খেতুর মন্দিরে গড়ে তোলেন স্থাপনা। এরপর তিনিই প্রথমে এখানে এ উৎসবের আয়োজন করেন। ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে তার কাছে এসে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেন।
১৬১১ খ্রিস্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাস নিত্তলীলায় প্রবেশের মানসে গঙ্গাস্নানের বাসনা প্রকাশ করেন। শিষ্যরা তাকে গঙ্গাজলে নিয়ে গেলে নিজের দেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয় শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ও রামকৃষ্ণকে আদেশ করেন তার দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় নরোত্তমের ওই দুই শিষ্য তার দেহ মার্জন করতে থাকলে পুরো দেহ এক সময় সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিত হয়ে যায়। এরপর থেকেই দুর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার এই মহান সাধকের কৃপা লাভের আশায় খেতুরীধামে বছরে একবার মিলিত হয়ে থাকেন। এটি হয়ে থাকে বাংলাদেশে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। তবে এই প্রথম সেই সমাবেশ হচ্ছে না।