নজরুল ইসলাম জুলু: বর্তমানে বাংলাদেশসহ গোটাবিশ্বই যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা কারোরই অজানা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও চালছে অঘোষিত ‘লকডাউন’। এহেন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর, যানবাহন চালক, শ্রমিক ইত্যাদি শ্রেণিপেশার মানুষ। প্রায় টানা ১৫ দিন থেকে কাজকর্ম নেই!
আর কর্ম না থাকলে পারিশ্রমিক আসবে কোথায় থেকে? কিন্তু কাজ নেই বলে তো জীবন থেমে নেই। জীবনের অমোঘ নিয়মেই জীবন চলছে। দিনশেষে একমুঠো খাবার হলেও তুলে দিতে হচ্ছে বৃদ্ধ মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখে। তাই ঘরে খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী না থাকায় অর্ধাহারে অনাহারে এখন দিন-রাত কাটছে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষের। ঘরবন্দি হওয়ার পর তাদের জীবন যে কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তা এখন বর্ণনাতীত।
অনেকেই বলছেন- প্রাণঘাতী করোনায় না মরলেও না খেয়ে মরতে হবে তাদের মত খেটে খাওয়া মানুষের। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এরই মধ্যে মোট পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তা প্রত্যাশিতই ছিল। সর্বব্যাপ্ত এই দুর্যোগের সময় দেশের অর্থনীতির সব খাত যখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তখন সরকার কেবল স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে বসে থাকতে পারে না। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ।
ঘোষিত এই আর্থিক সহায়তা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আড়াই শতাংশের বেশি। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন- এই দুর্যোগে দেশের একটি মানুষও যেন অভুক্ত না থাকেন। তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ প্রতিটি জেলা উজেলা পযার্য়ে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে সরকারি ত্রাণ নিয়ে কেউ যেন আবার নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন না ঘটান সে ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন এবং কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন- ‘ত্রাণ নিয়ে নয়-ছয় করলে আমি কাউকে ছাড়বো না।
অসহায় মানুষের জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বারংবার হুঁশিয়ারির পরও আমরা প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্র-পত্রিকা ও নিউজ চ্যানেলগুলোতে ত্রাণ সাহায্য নিয়ে নানান রকম অনিয়মের খবর দেখছি।
জোড়ালো অভিযোগ উঠছে ত্রাণ তালিকার স্বচ্ছতা নিয়েও। অসহায় দুস্থ অনেকেই অভিযোগ করছেন ত্রাণ না পাওয়ার। আবার অনেকেই বলছেন-এমন অনেককেই ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে যারা সঠিক হকদার না। অর্থাৎ যারা ত্রাণ সাহায্য পাওয়ার যোগ্য তারা পাচ্ছেন না। সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার হচ্ছে এই দুর্দিনেও একশ্রেণির মানুষ ত্রাণের নামে চালাচ্ছে ব্যক্তিগত ও দলীয় প্রচারণা।
ত্রাণের ব্যাগে ব্যক্তিগত ছবি ছাপিয়ে শতশত মানুষের সমাগম ঘটিয়ে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ত্রাণের নামে নিজেদের ক্ষমতা ও ব্যক্তি প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে সাংবাদিকদের ফোন করে অনুরোধ করছেন তাদের ত্রাণ দেওয়ার নিউজ কভারেজের জন্য। অথচ করোনা পরিস্থিতি যেন ভয়াবহ রূপ নিতে না পারে সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সামগ্রী বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছেন। যা এখম কেউই কর্ণপাত করেছেন না বলেই খালি চোখে দেখা যাচ্ছে।
সবাই জনসমাগম করেই সংবাদকর্মীদের ডেকে ছবি তুলে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছেন। এতে করে নানাভাবেই ত্রাণ সাহায্য নিতে আসা অসহায় মানুষগুলো সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। আবার এর মাধ্যমে ব্যাপকহারে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া যে পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে তা যথেষ্ট নয় বলেও অনেকে জানাচ্ছেন।কারণ যে পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে তা দিয়ে অনেক অসহায় পরিবারের ৪/৫ দিনের বেশি যাচ্ছে না। এর ফলে পেটের তাগিদে তাদের বাড়ির বাইরে বের হতেই হচ্ছে।
এতে করোনায় সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছেই। আবার অনেকেই এমন আছেন যাদের নিজেদের থাকা খাওয়ার কোন ঠিক নেই কিন্তু ত্রাণ তহবিলের নামে পাড়া-মহল্লা বা বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গের কাছ থেকে চাঁদা তুলে সেই টাকার বড় অংশ নিজেরা আত্মসাৎ করে বাকিটুকু দিয়ে নামমাত্র ত্রাণকার্য চালাচ্ছেম। আরনদলীয় লোকজন বা আত্মীয় স্বজনদের ত্রাণ সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ তো আছেই।
বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলোর কল্যাণে দেখছি সরকারি ত্রাণের চাল অসাধু মানুষেরা কিভাবে লুকিয়ে রাখছে আবার ধরাও পড়ছেন। কিন্তু এ কথা বলার আর অপেক্ষা থাকে না যে আমরা সবাই খুব কঠিন সময় পার করছি। খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। গাই দয়া করে কেউ এই দুর্যোগে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা করবেন না।
অনেক হয়েছে এবার ত্রাণ নিয়ে প্রচার প্রচারণা বাদ দিন। প্রকৃত অসহায় মানুষদের তালিকা তৈরি করুন। এরপর প্রকাশ্যে না দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিন। দলীয় বা ব্যক্তিগত প্রচার প্রচারণার জন্য ভবিষ্যতে অনেক সময়-সুযোগ পাবেন। দয়া করে এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে ত্রাণ সাহায্যের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। কোন অসহায় দুস্থ দরিদ্র, মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত কেউই যেন ত্রাণ সাহায্য থেকে বঞ্চিত না হোন তা সুনিশ্চিত করুন। আল্লাহর ওয়াস্তে স্বজনপ্রীতি আর দলপ্রীতি বাদ দিন। আল্লাহ সবাইকেই হেফাজতে রাখুন, সুস্থ রাখুন। সবাইকেই নিজ নিজ দ্বায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের হেদায়েত দান করুন।
নজরুল ইসলাম জুলু, সিনিয়র সাংবাদিক, রাজশাহী ।