রাশেদুল ইসলাম,
নাটোর প্রতিনিধিঃ উত্তরাঞ্চলের শস্য ভান্ডারখ্যাত নাটোর জেলায় মাছ চাষ লাভ জনক হওয়ায় জেলার ৭টি উপজেলাতেই পড়েছে পুকুর কাটার হিড়িক। আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খনন করায় কমছে কৃষি জমি। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার। চাষাবাদের হচ্ছে ব্যাপক ক্ষতি।
অপরদিকে রাস্তার অপরদিয়ে মাটি বহনের ফলে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। অপরদিকে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়ায় বিক্ষুদ্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে মাটি খননের কাজে ব্যবহৃত এস্কোভেটরি মেশিন (ভেকু)। তারপরেও স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়না। অথচ আইনে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে জমির শ্রেণি পরিবর্তন সহ কৃষি জমিতে পুকুর খনন করতে হলে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদন লাগবে। কৃষি বিভাগের হিসেব মতে বিগত ৪ চার বছরে জেলায় আবাদি জমি কমেছে ৬৪৮৭ হেক্টরে। দুই ফসলি ও তিন ফসলি এসব আবাদি জমি এমন আশংকাজনক হারে কমে যাওয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাটোরের জেলা প্রশাসন এবং কৃষি বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এভাবে চলছে থাকলে খাদ্যউদ্বৃত নাটোর জেলায় অচিরেই খাদ্যের সংকট দেখা দেবে। তবে কি পরিমান পুকুর বাড়ছে সেই হিসেব নেই কৃষি বিভাগ বা মৎস বিভাগের কাছে।
গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের দুর্গাপুর-বাবলাতলা গ্রামের কৃষক হারুন প্রামাণিক, সাহাদ, শামীম ও শীতলের প্রায় ১০ বিঘা জমি স্বল্প মূল্যে লিজ নিয়েছেন একই গ্রামের বাসিন্দা বদর আলী। হাঁড়িভাঙ্গা বিলের লিজ নেয়া সেই জমিতেই শুরু করেন পুকুর খনন। পাশের ৯ বিঘা জমিতে আরেকটি পুকুর খনন চলছে। হাঁড়িসভাঙ্গা বিলে জমি আছে এমন অন্তত ১৫ জন কৃষক বলেন, বিল এলাকায় কমপক্ষে ২০টি পুকুর খনন করা হয়েছে। আরও ১০টি পুকুর খননের কাজ চলছে। এর মধ্যে ফিরোজ হোসেন তালুকদারের ১৪ বিঘা ও ছয় বিঘা আয়তনের দুটি, নজরুল ইসলামের ১২ বিঘা, ফজলুর রহমানের ১২ বিঘা, মিজানুর রহমান তালুকদারের ১০ বিঘা জমির পুরোটা পুকুর করা হচ্ছে। অন্য প্রভাবশালী জমির মালিকেরাও পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছেন। বিলে পুকুর খনন বন্ধের দাবিতে স্থানীয় জমির শতাধিক মালিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তেমন কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে উত্তেজিত জনতা গত ২৩ মার্চ রাতে মাটি কাটার জন্য ব্যবহৃত দুটি এক্সেকেভেটর মেশিন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এরপরেও গুরুদাসপুরে থেমে নেই মাটি কেটে পুকুর খনন। বিয়াঘাট ইউনিয়ন ছাড়াও চাপিলা,ধারা বারিয়া ইউনিয়নে চলছে পুকুর কাটা । এ বিষয়ে গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়াসমিন আক্তার বলেন, কৃষিজমিতে পুকুর খননের সুযোগ নেই। কেউ পুকুর করতে চাইলে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু হাঁড়িভাঙ্গা বিলে পুকুর খননকারীরা সেই নিয়ম অনুসরণ করেননি। তিনি কৃষকদের লিখিত অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এর সত্যতা পেয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পুকুর খনন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, কৃষি জমিতে পুকুর খনন বন্ধে দুই দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে।
এছাড়া সিংড়া উপজেলার সোনাপুর, পমগ্রাম, পুঠিমারী, কুশাবাড়ী, নীলচরা, পাটকান্দি, খাগোরবাড়িয়া, মটগ্রাম, ধুলিয়াডাঙ্গা, লারুয়া, বড়সাঔল, নলবাতা, দিঘোলগ্রাম, আরকান্দি, চৌগ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সর্বত্রই তিন ফসলি ও দো ফসলি জমিতে পুকুর কাটতে দেখা গেছে এসব পুকুর কাটার সাথে জড়িত রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। গত ১১ই মার্চ পুকুরের মাটি বহন করার সময় ইট ভাটার ট্রলির ধাক্কায় আবু সালাইন নামে কুশাবাড়ী মসজিদের ইমাম নিহত হয়। নিহত আবু সালাইন সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর গাড়াদহ এলাকার ইব্রাহীম আকন্দের ছেলে।
পুলিশ জানায়, ওই দিন সকালে কুশাবাড়ি থেকে আবু সালাইন মোটরসাইকেল যোগে সিংড়া যাওয়ার পথে। শেরকোল-পুঠিমারী আঞ্চলিক সড়কের পমগ্রাম নামক স্থানে পৌঁছালে এসময়য় ইটভাটার মাটিবাহী এক ট্রলির পিছন থেকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
ক্রমাগত পুকুর কেটে মাটি বহনের ফলে আকস্মিক বৃষ্টিতে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে সিংড়ার পাচবাড়িয়া এলাকায় জমে থাকা মাটি পিচ্ছিল হয়ে সাড়ে আট ঘন্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। শনিবার ভোর ৪টা থেকে দুপুর সাড়ে বারটা পর্যন্ত শেরকোল থেকে ডালসড়ক পর্যন্ত যানজটে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ে। এরপর যানবাহন চলাচল সিমিত আকারে চলাচল শুরু হলেও বেলা ৩টার দিকে যানজট মুক্ত হয়। এছাড়াও শুক্রবার বিকেলেও একই কারণে প্রায় তিন ঘন্টা যান চলাচল বন্ধ হয়ে হাজারো যাত্রীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আর এই ঘটনার সাথে পুকুর খননকারী ও ইটভাটা মালিকদের দায়ী করছে স্থানীয় প্রশাসন। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাটি ফেলে রাস্তা নষ্ট করার অভিযোগে ৩জনের ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। গত ২৪ মার্চ এঘটনা ঘটে।
অপরদিকে লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া ,বিলমাড়িয়া, দুড়দুড়িয়া, লালপুর, দুয়ারিয়া, কদিমচিলান ইউনিয়নে চলছে পুকুর কাটা। এসব পুকুর কাটার প্রশাসনের নেই কোন অনুমতি। এ বিষয়ে লালপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম বলেন এভাবে পুকুর খনন চলতে থাকলে লালপুরে কৃষি জমি একেবারে কমে যাবে। এতে পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। আমরা সবসময় কৃষকদের অনাবাদি জমিতে পুকুর খননের পরামর্শ দেই। কিন্তু কিছু অসাধু কৃষক বেশি লাভের আশায় কৃষি জমিতে পুকুর খনন করেন।
লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন, কৃষি জমিতে পুকুর খনন কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সরেজমিনে গিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যদি কৃষি জমিতে পুকুর খনন করা দেখি তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বড়াইগ্রাম উপজেলাতেও চলছে অনুমোদনহীন পুকুর খনন। চান্দাই ইউনিয়ন সদরের এহিয়া ও বাকী অনুমোদন না নিয়েই পুকুর খনন করছেন। উপজেলার চেচুয়ার বিলে ধারাবারিষা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক রিপন সরকার চেচুয়ার বিলে দ্বারিকুশী মৌজায় সরকারী ১০ বিঘা খাস জমি সহ ৪৮ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন। বিলের মাঝ বরাবর উচু করে পুকুর খনন করার ফলে জলাবদ্ধাতা তৈরির আশংকা করছেন এলাকাবাসী । এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী । ভবানীপুর গ্রামেও চলছে একই অবস্থা। অনুমোদন না নিয়েই চলছে পুকুর খনন।
এ ছাড়া নাটোর সদর উপজেলার আগদিঘা, মাঝদিঘা, মির্জাপুর দিঘা শংকরভাগ ,পিপরুল ,বাশভাগ, সেনভাগ , শ্যামনগর লক্ষীকোল সহ বিভিন্ন স্থানে চলছে পুকুর খনন। শংকরভাগ বাজারের দক্ষিণে মাউত বিলে অনেক গুলো পুকুর কাটার ফলে বিলের পানি নস্কিাশন বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার আশংকা করছেন এলাকাবাসী ।
নলডাঙ্গা উপজেলার কাসারীপাড়া গ্রামের বাবুল হোসেন মিনু, শাখারীপাড়া মাদরাসার পাশে আমবাগান কেটে পুকুর তৈরি করছেন বানী ইসরাইল, রাশার কাজীপুর গ্রামের ফাত্তাহ মুন্সী , ছোট সিংগা গ্রামের এরশাদ আলী পুকুর তৈরি করছেন।
সাবেক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেন, কোন প্রতিকার পাননি তারা ।
নাটোরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, নাটোরের মত উর্বর তিন থেকে চার ফসলি এমন জমি দেশের খুব কম যায়গাতেই আছে। সে কারণে নাটোর জেলা শস্য ভান্ডার হিসাবে খ্যাত। নাটোরে প্রচুর পরিমান মুগ ডাল, রসুন, ধান, গম, আখসহ বিচিত্র রকমের ফসল হয়। এই জেলার পেয়ারা আম এবং ড্রাগন ফল সারাদেশে খুবই সমাদৃত। কিন্তু যেভাবে আবাদি জমি কমছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তা ধরে রাখা সম্ভব হবেনা। ইটভাটা মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকদের আবাদি জমিতে পুকুর কেটে ভাটাতে মাটি বিক্রি করছেন বলেও জানান তিনি। তবে সাময়িক লাভ হলেও ভবিষ্যতের জন্য বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। সেসব জমি পুকুর কাটা হচ্ছে তা পুনরায় আবাদি জমিতে ফিরে আসা সম্ভব হবেনা।
নাটোর জেলাতে ২০১৩-১৪ মৌসুমে নাটোরে আবাদি জমির পরিমান ছিল ১,৫৩,৬৭৪ হেক্টর, ২০১৪-১৫ ১,৫০,৮৩৮ হেক্টর, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ১,৪৮,৭৪৩ চলতি মৌসুম ২০১৬-১৭ তা কমে দাড়িয়েছে ১,৪৭,১৮৭ হেক্টর জমিতে।
কৃষকরা জানান, জমিতে ফসল উৎপাদনের চেয়ে মাছ চাষ লাভ জনক হওয়ায় তারা পুকুর কেটে মাছ চাষের দিকে ঝুকে পড়েছেন। নাটোর সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষক ইমরান আলী খাজা বলেন, ফসলের চেয়ে মাছচাষ লাভজনক বলে তিনি তার ১২ বিঘা আবাদি জমি কেটে পুকুর তৈরি করছেন। জমিতে ফসল করে যে খরচ হয় ফসল বিক্রি করে তার মুলধনই ফেরত আসেনা। তিনি বলেন এক বিঘা ফসলি জমি লিজ দিলে বড়জোড় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু সমপরিমান জমির পুকুর লিজ দিলে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়।
সদর উপজেলার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষক আতিকুল ইসলাম আতিক বলেন, যেভাবে পুকুর বাড়ছে ঠিক একইভাবে মাছের দাম কমছে। অদূর ভবিষ্যতে মাছ খাওয়ার লোক থাকবেনা। তাছাড়া যেভাবে বিভিন্ন খাদ্য খাইয়ে মাছকে দ্রুত বড় করা হচ্ছে তাতে মানবদেহর জন্য হুমকি হয়ে দাড়াবে এসব বিষাক্ত মাছ।
নাটোর সদর উপজেলার কৃষি অফিসার মেহেদুল ইসলাম ও নলডাঙ্গা কৃষি অফিসার আমিরুল ইসলাম বলেন, যেভাবে পুকুর কাটা হচ্ছে তা যদি সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় বন্ধ করা না যায় তবে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিবে। আবাদি জমিতে পুকুর খনন কঠোর ভাবে বন্ধ করতে প্রসাশনের পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানা তিনি। তিনি বলেন কোন জমি ফসল উৎপাদনের উপযোগী হতে প্রায় আড়াই লক্ষ বছর সময় লাগে। সে কারনে অবহেলা করে আবাদি জমি কাউকে নষ্ট করতে দেয়া উচিত না।
নাটোর জেলা মৎস কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা ও নলডাঙ্গ উপজেলা মৎস অফিসার মো ইব্রাহিম হামিদ শাহিন বলেন, মাছ চাষকে কোন ভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। তবে তা পরিকল্পিত এবং আইন মেনে হতে হবে। নাটোরে যেভাবে অপরিকল্পিত পুকুর খনন হচ্ছে তাতে মাছ চাষের যেমন ক্ষতি হচ্ছে একইভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে যাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর চেয়ে বর্তমানে মাছ উৎপাদন বেড়েছে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, মানুষ কেন বুঝতে চাচ্ছেনা যে আবাদি জমি কমে গেলে তাদের জীবন সংকাটপ্ন হবে। আবাদি জমি রক্ষা করার ব্যাপারে মন্ত্রনালয়ের সাথে কথা বলেছেন বলে জানান তিনি। শাহিনা খাতুন আরো বলেন, ফসলি জমিতে পুকুর খনন বা শিল্পায়ন কঠোর হাতে দমন করা হবে।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/রখ