মহামারি করোনা ভাইরাস গোটা পৃথিবীকে স্থবির করে দিলেও এটিকেই কেন্দ্র করে কেউ কেউ হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অপরাধী। যে ভাইরাসটি সাধারণ মানুষের আচরণে পরিবর্তণ ঘটালেও কারো মাঝে ঘটিয়েছে উল্টো ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে থেমে থাকেনি গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রমও। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একাধিক অভিযান আর প্রতারণা-জালিয়াতির কয়েকটি ঘটনা বড় আলোচনার জন্ম দেয় বিদায় হতে যাওয়া বছর-২০২০ এ। করোনাকে কেন্দ্র করে লকডাউনের মধ্যে কয়েক মাস চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি এমনকি খুনের মত অপরাধ কমে আসার খবর এসেছিল বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আগের বছরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাদের বিচারের কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে মহামারির কারণে। তবে এর মধ্যেও প্রকাশ হয়েছে নতুন নতুন চরিত্রের নতুন অপরাধের খবর।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগেই ওয়েস্টিন হোটেলে কক্ষ ভাড়া নিয়ে কয়েকজন তরুণীকে দিয়ে ‘যৌন ব্যবসা’ চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে আলোচনায় আসেন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক (বহিষ্কৃত) শামীমা নূর পাপিয়া।
এরপর মহামারির মধ্যে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও পরীক্ষার নামে জালিয়াতির ঘটনায় রিজেন্ট হাসপাতাল, জেকেজি হেলথ কেয়ার ও সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান, সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়ে ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তার, মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সিনহা হত্যায় ওসি প্রদীপ এবং একাধিক পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তারসহ নানান ঘটনা নিয়ে দেশে তোলপাড় হয়।
১) মেজর সিনহা হত্যার পর কথিত ‘বন্ধুকযুদ্ধ/ক্রসফায়ারে’ ভাটা:
প্রতিবছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে কথিত ‘ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যা থাকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চলতি বছরের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মৃত্যুর পর ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা হঠাৎ কমে আসার বিষয়টি একাধিক সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়।
ওই ঘটনায় সিনহার বোনের দায়ের করা মামলায় ইতোমধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে র্যাকব। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলিসহ ১৫ জনকে সেখানে আসামি করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ যেখানে ১৮৪ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এসেছে, সেখানে অগাস্ট মাসে ঘটেছে মাত্র একটি ঘটনা। সেপ্টেম্বরে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কারও মৃত্যু হয়নি। অক্টোবর আর নভেম্বরে নিহত হয়েছেন ১ জন করে।
২) পুত্রকাণ্ডে বেকায়দায় দাপুটে হাজী সেলিম:
নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের ঘটনায় ২০২০ সালে নতুন করে আলোচনায় আসেন পুরান ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী সেলিম ও তার ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিম। গত ২৪ অক্টোবর রাতে ধানমণ্ডি এলাকায় সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো হাজী সেলিমের একটি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর করা হয়। ওই ঘটনায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফানসহ ৭জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওয়াসিফ। পরদিন ২৫ অক্টোবর পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটের দেবীদাস লেইনে হাজী সেলিমের বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালায় র্যা ব। আটক করা হয় ইরফান ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে।
ওই ভবন থেকে দুটি অবৈধ পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করার কথা জানায় র্যা ব। পরে ইরফানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। একইসঙ্গে তাকে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদ থেকেও বরখাস্ত করা হয়। এরপর থেকে হাজী সেলিমের দখলে থাকা পুরান ঢাকার ও আশপাশের বিভিন্ন স্পটে অভিযান চালানো হচ্ছে। একইভাবে দুদকও হাজী সেলিমের অবৈধ সম্পতির খোঁজে নেমেছে।
৩) পাপিয়ার পাপ নামা:
নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া এবং তার স্বামী মফিজুর রহমান সুমনকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে ঢাকা ও নরসিংদীতে পাপিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়ার কথা জানানো হয়।
ওই সময় র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাপিয়া গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ চালিয়ে যে আয় করতেন, তা দিয়ে হোটেলে বিল দিতেন কোটি টাকার উপরে। গ্রেপ্তারের পর পাপিয়া ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে জাল নোটের ১টি এবং অস্ত্র ও মাদক আইনে ২টি মামলা দায়ের করে র্যাব। আর মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে সিআইডি আরো ১টি মামলা দায়ের করে।
এরপর দুদকও পাপিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নামে। ৪ অগাস্ট পাপিয়া ও তার স্বামীর নামে ৬ কোটি ২৪ লাখ ১৮ হাজার ৭১৮ টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে মামলা করে দুদক। এরইমধ্যে অস্ত্র মামলায় পাপিয়া ও সুমনের ২০ বছরের সাজার রায় হয়েছে।
৪) কোভিড-১৯ মেডিকেল সনদ জালিয়াতি:
করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যেই ভুয়া কোভিড-১৯ সনদ দেয়া এবং চিকিৎসার নামে প্রতারণার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে ধরা পড়েন রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের কর্তাব্যক্তিরা। বাতিল করা হয় ২টি প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাস চিকিৎসা ও পরীক্ষার অনুমোদন।
লাইসেন্স না থাকার পরও ‘কোভিড ডেডিকেটেড’ হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করার কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও মামলা করে দুদক।
জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদ এবং জেকেজির চেয়ারম্যান জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক সাবরিনা শারমিন হুসাইন ও তার স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরী। মার্চে করোনাভাইরাসরে প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নেয় জেকেজি। কিন্তু পরে জানা যায়, রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরীক্ষা না করে রোগীদের ভুয়া সনদ দিচ্ছিল তারা। এসব অভিযোগে ২২ জুন জেকেজির দুই কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে গ্রেপ্তর করা হয় আরিফুল ও তার স্ত্রী ডা. সাবরিনাকে। এরপর করোনাভাইরাসের ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আরও বেশি। বিনামূল্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও চিকিৎসা করাতে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল তারা। কিন্তু তারা নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট দিচ্ছিল এবং সরকারের কাছে বিল নেওয়ার পর রোগীর কাছ থেকেও অর্থ নিচ্ছিল। এসব অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে ৬, ৭ ও ৮ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরা শাখা বন্ধ করে দেয় র্যাব। সে সময় ৮ জনকে আটক করা হয়।
ওই অভিযানের গা-ঢাকা দেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম, যিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অনেক সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছিলো। এক পর্যায়ে গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা দেবহাটা সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর থেকে পিস্তলসহ তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তার বিরুদ্ধে একর পর এক আসতে থাকে প্রতারণা অভিযোগ। এর মধ্যেই অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে পুলিশের করা এক মামলায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাহেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
৫) মাস্ক কেলেঙ্কারি:
দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত মার্চে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ মাস্ক সরবরাহ করতে জেএমআই হাসপাতাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডকে কার্যাদেশ দিয়েছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সে সময় এন-৯৫ মাস্কের বাক্সে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পাওয়া গেলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসাকর্মীদের ‘মৃত্যুর ঝুঁকিতে’ ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে জেএমআই গ্রুপের এমডি মো. আব্দুর রাজ্জাকসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার পর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালতে জামিন পান।
৬) সাহাবউদ্দিন মেডিকেলে অভিযান:
রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের জালিয়াতি উন্মোচনের পর করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদ দেওয়াসহ নানা অনিয়ম পেয়ে ১৯ জুলাই গুলশানের সাহাবউদ্দিন মেডিকেলে যায় র্যাব। সে সময় বলা হয়, অনুমোদন না থাকলেও করোনাভাইরাসের র্যানপিড টেস্ট করছিল সাহাবউদ্দিন মেডিকেল। আবার পরীক্ষা ছাড়াই ‘ভুয়া সনদ’ দিচ্ছিল। করোনাভাইরাস নেগেটিভ রোগীকে পজিটিভ দেখিয়ে ভর্তি করা ছাড়াও ভিন্ন ল্যাব থেকে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নিজেদের প্যাডে প্রতিবেদন দিচ্ছিল তারা।
লাইসেন্সের মেয়াদ ১ বছর আগে উত্তীর্ণ হলেও তা নবায়ন না করেই কাজ চালিয়ে আসছিল ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযানে হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে ১০ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিক্যাল সামগ্রী ও ওষুধ পাওয়া যায়। ওই অভিযানের পর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবুল হাসনাতকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সল আল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়।
৭) ক্যাসিনোকাণ্ডে দুই ভাই এনু-রুপন গ্রেপ্তার:
গত ১৩ জানুয়ারি ক্যাসিনোকাণ্ডের হোতা গেণ্ডারিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায় একটি ১০ তলা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা ওই বাসার টয়লেটের ওপরে ফাঁকা অংশে লুকিয়েছিলেন। পুরান ঢাকার এ দু’ভাই জাল পাসপোর্টে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ৪০ লাখ টাকা ও ১২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
৮) নবাব পরিবারের সন্তান পরিচয়ে প্রতারণা:
গত ২৮ অক্টোবর নবাব পরিবারের সন্তান পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে নবাব খাজা আলী হাসান আসকারীকে (৪৮) পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফুপু পরিচয় দিতেন তিনি। আরও বলতেন, দুবাইয়ে তার গোল্ডের কারখানা রয়েছে। বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, থাকেন নিউইয়র্কে।
জেএন