ইমরান আলী, ঢাকা : পলাতক বা কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙ্গিয়ে সারাদেশে চাঁদাবাজির জাল বিছিয়েছে একাধিক চক্র। দেশের বিশিস্ট ব্যবসায়ীসহ উচ্চ পদস্থ চাকুরীজিবীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তিন ধাপে নিরব চাঁদাবাজিতে লিপ্ত এই চক্র। এ চক্রের হুমকির প্রেক্ষিতে অনেকেই চাঁদাও দিচ্ছেন। সম্প্রতি কক্সবাজারের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর নিকট শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নাম করে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে অন্যথায় হত্যার হুমকি দেয় এক চক্র। ব্যবসায়ী তাদের হুমকির প্রেক্ষিতে টাকাও দেন। পরবর্তীতে আরো টাকা দাবি করলে তিনি পুলিশের সরনাপন্ন হলে পুলিশ এ চক্রের ৬ জনকে আটক করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, এ ধরনের একাধিক চক্র তৎপর রয়েছে। যারা পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম করে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। কথিত ফাইভ স্টার, সেভেন স্টার গ্রæপের নাম করে এরা চাঁদাবাজি করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, ইমন, মামুন, শাহাদাৎ, কারাগারে থাকা কাইল্যা পলাশসহ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম করে দেশে চাঁদাবাজির জাল বিছিয়েছে একাধিক চক্র। বিশেষ করে তারা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে থাকে। দেশের যে কোন স্থানেই হোক এ চক্রটি তাদের মোবাইল কিংবা টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে থাকে। এরপর তিনটি ধাপে তারা তার নিকট চাঁদা দাবি করে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে তাদের ফোন করা হয়। এরপর বড় ভাই সম্বোধন করে একজনের সঙ্গে কথা বলাই। তৃতীয় ধাপটি টাকা নেয়। অনেক ব্যবসায়ী হুমকির কারণে প্রাণভয়ে তাদের টাকাও দেয়। সন্ত্রাসী জিসানের নামেই একাধিক গ্রæপ রয়েছে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের হুমকি আসলেই তাদেরকে জানাতে। তাহলে এ চক্রগুলো চাঁদাবাজির সাহস পাবেনা পাশাপাশি আইনের আওতায় আনা যাবে।
সম্প্রতি কক্সবাজারের ব্যবসায়ী তিনি ঢাকাসহ খুলনা, চট্রগ্রাম, নারায়নগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার নিকট চাঁদা চাওয়ার ঘটনায় এ চক্রের অন্যতম একটি গ্রæপের প্রধানসহ ৬ জনকে আটক করে।
গতকাল শনিবার তাদের গ্রেফতারের কথা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের সদস্য পদোন্নতি প্রায়া অতিরিক্ত ডিআইজি ওয়ালিদ হোসেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো, চক্রের প্রধান বেল্লাল খান, রাকিব খান টিটুল, মো. আবদুল হান্নান, মো. দেলোয়ার হোসেন, মো. সোহাগ এবং খোরশেদ আলম।এ সময়ে তাদের কাছ থেকে মোবাইল, সিমকার্ড ও নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, তুরাগ ও পল্টন এলাকা থেকে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি দল।
সংবাদ সম্মেলনে ওয়ালিদ হোসেন বলেন, বেশকিছুদিন আগে কক্সবাজারের এক ব্যবসায়ীকে মোবাইল ফোনে টাকা চওয়া হয়। টাকা না দিলে তাকে ও তার ছেলেকে হত্যা-গুম করবে বলে হুমকি দেয়। ওই ব্যবসায়ী ভয় পেয়ে প্রতিমাসে তাদেরকে পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে থাকেন। এভাবে তাদেরকে ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছেন ওই ব্যবসায়ী। এরপর ওই চক্রটি তার কাছে আরো বড় অংকের টাকা দাবি করলে তিনি ডিএমপির গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ করেন।
ওই ব্যবসায়ী খুলনা, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় ব্যবসা করতেন। তার অভিযোগ পেয়ে ডিএমপির গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের এডিসি মনিরের নেতৃত্বে তদন্ত শুরু করে। এরা ৮ থেকে ১০ জনের একটি চক্র। এই চক্রটির প্রথম গ্রæপের সদস্যরা ঢাকার নীলক্ষেতের পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে, বিভিন্ন বই ব্যবসায়ী, বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির বার্ষিক সদস্যদের (ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরের তালিকা) টেলিফোন গাইড সংগ্রহ করে দ্বিতীয় গ্রæপকে দেয়। দ্বিতীয় গ্রæপ ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী সেভেনস্টার গ্রæপের জিসানের নাম করে সেভেনস্টার গ্রæপের কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ফোনে টাকা চেয়ে থাকে। তাদের ফোনে অনেকে ভয় পেয়ে টাকা দিয়ে দেয়। তারা ভিকটিমদের বিকাশ বা নগদের বিভিন্ন হিসাবে টাকা দিতে বলে।
তৃতীয় গ্রæপটি ওই হিসাব থেকে টাকা সংগ্রহ করে। আমরা প্রথমে এই গ্রæপের প্রধান বেলাল খানকে গ্রেপ্তার করি। পরে তার টুআইসি টুটুল খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পর্যায়ক্রমে তাদের গ্রæপের আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে একটি ডাইরি উদ্ধার করা হলে তার মধ্যে ভিকটিমদের তালিকা পাওয়া যায়।
এরা কিভাবে বিকাশ কিংবা নগদের হিসাব নম্বর খোলে এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়ালিদ হোসেন বলেন, এরা বিভিন্ন নিরীহ লোকদের ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে হিসাব খোলে।
এই গ্রæপটি মাদারীপুর নারায়ণগঞ্জ ও বরিশাল কেন্দ্রিক কাজ করে। তাদের একটি গ্রæপ ঢাকায় রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও চাঁদাবাজি আইনে ছয়টি মামলা রয়েছে।
কে এই জিসান
জিসানের পুরো নাম জিসান আহমেদ মন্টি। ঢাকার আলোচিত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমের সঙ্গে মিলে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন জিসান। এই ত্রয়ীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল আরেক ক্যাসিনো গডফাদার ইসমাইল হোসেন সম্রাটের।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত এক দশকে দেশের শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর নাম তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের অন্যতম হলেন জিসান। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বাড্ডা, ফকিরাপুল, পল্ট মতিঝিলসহ বেশ কিছু অঞ্চলে তার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ওই সব এলাকার সরকারি ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন তিনি। ইন্টারপোল তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে জিসান সম্পর্কে বলা আছে, তার বিরুদ্ধে হত্যাকাÐ ঘটানো এবং বিস্ফোরক বহনের অভিযোগ আছে।
২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুজন ডিবি পুলিশকে হত্যার পর আলোচনায় আসেন জিসান। এর পরেই গা ঢাকা দেন। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে সে দেশ ছাড়ে বলে ধারণা করা হয়।
সূত্র জানায়, সেই সময় পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন জিসান। এর পর নিজের নাম পরিবর্তন করে আলী আকবর চৌধুরী নামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ঠিকানা দেখানো হয়েছে সারদা পল্লী, ঘানাইলা, মালুগ্রাম শিলচর, চাষার, আসাম। বাবার নাম হাবিবুর রহমান চৌধুরী। মায়ের নাম শাফিতুন্নেছা চৌধুরী। আর স্ত্রীর নামের স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে রিনাজ বেগম চৌধুরী। পাসপোর্ট ইস্যুর স্থান দুবাই হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৭ জুন প্রদান করা পাসপোর্টটির মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ২০১৯ সালের ৬ জুন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের খবর, চলতি বছরের ৬ জুন পাসপোর্টটির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর ফের ভারতীয় পাসপোর্টটি ১০ বছর মেয়াদের নবায়ন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুবাইয়ে শীর্ষসন্ত্রাসী জিসানের দুটি রেস্টুরেন্ট আছে; আছে গাড়ির ব্যবসাও। এসব দেখভাল করেন তার ছোট ভাই শামীম এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শাকিল মাজহার। এর মধ্যে শাকিল মাজহার যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সহসম্পাদক রাজিব হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এ হত্যাকাÐের পর পালিয়ে দুবাই চলে যান তিনি।
সা¤প্রতিক দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দুই যুবলীগ নেতা জিকে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটকের পর তার (জিসানের) নাম ফের নতুন করে আলোচনায় আসে। তাদের মধ্যে একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্ব›েদ্ব জিসান শামীম ও খালেদকে হত্যা করতে লোক ভাড়া করেছিলেন।
সূত্র জানায়, জিকে শামীমকে ঘিরে ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে জিসানের বিরোধ তৈরি হয়। এ সিন্ডিকেটের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন আরেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। বিরোধের একপর্যায়ে জিসান খুবই ক্ষুব্ধ হন তাদের ওপর। অবস্থা ভিন্ন দিকে চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় জিসানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে সমঝোতা বৈঠকের আয়োজন করেন খালেদ।
গত জুনের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরে যান জিকে শামীম, মহানগর যুবলীগের ওই শীর্ষ নেতা ও খালেদ। আর জিসান দুবাই থেকে সেখানে যান। সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে এলাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে তাদের বৈঠক হয়। যদিও বৈঠকে শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে কিলিং মিশনে অংশ নিতে দুবাই থেকে ঢাকায় পাঠানো হয় জিসানের সহযোগীদের।
ঢাকার টেন্ডারবাজ জি কে শামীম গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, আগে কখনো এত দেহরক্ষী রাখেননি তিনি। মূলত জিসানের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হওয়ার পর থেকে ‘ভয়ে’ বড় নিরাপত্তা টিম গঠন করেন জিকে শামীম।
সরকারের পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষসন্ত্রাসীর মধ্যে অন্যতম জিসান। এ তালিকার অন্যরা, যারা এক সময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপাত, তাদের কেউ এখন বিদেশে, কেউবা কারাগারে।
এস/আর