বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে গ্রামীণ ও কৃষিনির্ভর চর এলাকায় রাসেলস ভাইপার সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তবে সম্প্রতি এর উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ছে। পদ্মা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন জেলায় এটি বেশি দেখা যাচ্ছে এবং মানুষকে দংশনের ঘটনাও ঘটছে। তাই এখন এই সাপ নিয়ে আলোচনা ও আতঙ্ক দুটিই ছড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রকল্প ভেনম রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের প্রায় ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপার আছে।
জানা গেছে, অধিক প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন এই সাপ ডিম না দিয়ে একসঙ্গে ২০ থেকে ৮০টি পর্যন্ত জীবন্ত বাচ্চা প্রসব করতে পারে। ফলে খুব সহজে এসব বাচ্চা বন্যার পানির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। পরবর্তীতে পূর্ণবয়স্ক হয়ে আবারও বংশবিস্তার করছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণে চরাঞ্চল এবং নদীর তীরবর্তী লোকালয়ে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব সকলের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান রাসেলস ভাইপার মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কৃষির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক।
দেশব্যাপী রাজত্ব গেড়ে বসা এক সময়ের বিলুপ্ত বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার। রাজশাহী এবং এর আশে পাশে ছাড়াও সাপটির খোঁজ মিলছে বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর এমনকি ঢাকার আশপাশেও। অস্তিত্ব মিলেছে ২৭টি জেলায়। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এ সাপের কামড়ে মারা গেছেন ১০ জন।
রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি জেলায় ছড়িয়ে রাসেলস ভাইপার।
সরকারের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলছে পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে এই সাপ বেশি ছড়াচ্ছে। গবেষকেরা বলছেন, অনুকূল আবহাওয়ার কারণেই ছড়াচ্ছে রাসেলস ভাইপার। মূলত পদ্মা অববাহিকায় চাঁদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ এমনকি ঢাকাতেও দেখা মিলছে রাসেলস ভাইপারের। এটিই একমাত্র বিষধর সাপ, যে বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে জন্ম নেয় ৪০ থেকে ৫০টি বাচ্চা। কোন কোন সাপ ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। এই সাপের কামড়ে দেড় বছরে শুধু রাজশাহী মেডিকেলেই মারা গেছেন অন্তত ১৮ জন। এ সময়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮ জন।
রাজশাহীতে নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি বাড়ার কারণে মৎস ও কৃষিজীবি মানুষ রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে রয়েছে। আতঙ্কে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকায় স্থানীয়রা বিষধর এ সাপকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
এখন পর্যন্ত রাসেল ভাইপার সাপের ছোবলের শিকার হয়েছেন অনেকেই। বিশেষ করে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধির পর থেকে চর এলাকার মানুষ বেশি আতঙ্কে রয়েছেন।
রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া নেতিবাচক তথ্যগুলো দেখে আতঙ্কিত চারঘাট উপজেলাবাসী।উল্লেখ্য, চারঘাট উপজেলার প্রায় ২১ কি.মি. দীর্ঘ এলাকা পদ্মা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় অত্র তীরবর্তী ও চরাঞ্চলগুলোতে কৃষকরা কৃষি চাষাবাদ করেন। এ সকল এলকাবাসীদের কথা বলে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে এই সাপ প্রচুর পরিমাণে দেখা যাচ্ছে।
গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী, সারদা ও কুঠিপাড়া সংলগ্ন নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে প্রায় ১৬টি এই সাপের বাচ্চা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা যায়। গত কয়েক মাসে উপজেলায় ২ জন এই সাপের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে মোক্তারপুর গ্রামের রাজশাহী ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় এলাকাবাসী।
জেলা বণ্যপ্রাণী পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে এর বৈজ্ঞানিক কোন তথ্য নয়। তবে সাপের সংখ্য বৃদ্ধি পেতে পারে। কৃষি জমিতে ফলন বেশি হলে ইঁদুরের সংখ্যা বা বংশ বিস্তার স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। সাপের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। যে কারণে সাপ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে এবং তাদের বংশবিস্তার বেশি হচ্ছে।
এদিকে সাপ আতঙ্ক ও সাপের উপদ্রবে চর ছাড়া শুরু করেছে রাজশাহীর চরাঞ্চলের বাসিন্দারা। কখনো সাপ লোকালয়ে উঠে আসছে, আবার কখনো জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। এমন অবস্থায় সাপ আতঙ্কে দিন কাটছে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মার নদীগর্ভের ইউনিয়ন চকরাজাপুরে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের।
জানা গেছে, চকরাজাপুর ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চকরাজাপুর, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালিদাসখালী চর, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চকরাজাপুর চর। এ ছাড়া আংশিক টিকে আছে বাকি চরগুলো। এই চরের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ সাপ আতঙ্কে ঘর ছাড়ছেন।
সর্বশেষ চররাজাপুর খেয়াঘাটে গত সোমবার (৮ জুলাই) দুপরে চায়না দুয়ারি জালে ধরা পড়ে রাসেলস ভাইপার সাপ। পরে স্থানীয়রা সাপটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এ ছাড়া গত কয়েক দিন আগে চররাজাপুরের পূর্ব কালিদাষখালীর বাসিন্দা ফুলজান বেগমের (৫৫) শোয়ার ঘর থেকে একটি সাপ মারে স্থানীয়রা। তবে স্থানীয়রা সাপটির নাম শনাক্ত করতে পারেননি। এর আগে ২১ জুন পদ্মা নদীর চরআফড়া এলাকায় বাদামখেতে মধু বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তিকে রাসেলস ভাইপার কামড় দেয়।
সাপের কামড়, লোকালয়ে সাপ উঠে আসা, বিভিন্ন সময়ে জেলেদের জালে সাপ ধরা পড়া নিয়ে সাপ আতঙ্ক ছড়িয়েছে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে। এমন অবস্থায় অনেকেই ছাড়ছেন চর। বিকল্প হিসেবে অনেকেই বাঘা সদর, পাবনার ঈশ্বরদী, খাজানগর, মানিকের চরে আশ্রয় নিয়েছেন।
বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডিএম বাবুল মনোয়ার দেওয়ান বলেন, পানি বৃদ্ধি ও ভাঙন শুরু হওয়ার পর সাপ আতঙ্ক বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো কোনো সময় এলাকায় সাপও মারা পড়ছে। সাপে কামড় দেওয়ার পর সাপ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে এই চরে। আমার জানামতে, সাপের আতঙ্কে এই চরের অনেকে বাঘা সদর, পাবনার ঈশ্বরদী, খাজানগর, মানিকের চরে আশ্রয় নিয়েছেন।
গত ১লা জুলাই সকাল ৭টার দিকে বাঘা উপজেলার পদ্মার মধ্যে মানিকের চরে বাদাম উঠাতে গিয়ে শাকিল হোসেন (২০) নামে এক যুবক সাপের ছোবলে আহত হোন। শা কিল হোসেন পদ্মার মধ্যে চকরাজাপুর ইউনিয়নের দাদপুর চরের আকবর হোসেনের ছেলে।
বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু দেওয়ান বলেন,পদ্মায় নতুন পানি আসছে। পানির সঙ্গে সাপ ভেসে আসছে। এতে চরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাপ দেখলেই গ্রামবাসী লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করছেন।” সাপ আতঙ্কের কারণে
রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বিচারে রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য প্রজাতির সাপ নিধন হচ্ছে।
বন পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা ও প্রচারণা সত্ত্বেও রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। গত ২ সপ্তাহে রাজশাহী ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে শতাধিক রাসেলস ভাইপার মারা হয়েছে। প্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি বিলুপ্ত প্রায় এ সরীসৃপকে নির্বিচারে নিধন করলে জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে পরিবেশ। সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতামূলক পোস্ট দিয়ে প্রচারণা শুরু করলেও তাতেও কোনো ফল হচ্ছে না বলে জানা গেছে। লোকজন রাসেলস ভাইপার সন্দেহে অন্য প্রজাতির সাপও দেখামাত্র পিটিয়ে মারছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিসংলগ্ন পদ্মা পাড়ে ২৩ জুন বাচ্চাসহ ১৮টি রাসেলস ভাইপার নিধন করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাচ্চাগুলোর বয়স ছিল ৭ থেকে ৮ দিন। ৭ জুন জেলার গোদাগাড়ীর গাঙ্গোপাড়ায় এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি কাটার সময় একটি মা রাসেলস ভাইপারের সঙ্গে অনেক বাচ্চা কিলবিল করে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে মাসহ ৫৩টি বাচ্চাকে দলবদ্ধভাবে উৎসাহের সঙ্গে পিটিয়ে মারা হয়।
২১ জুন নাটোরের লালপুরের ঘাটছিলান গ্রামের একটি ধানের চাতালে রাসেলস ভাইপার দেখে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেন শ্রমিকরা। ২৩ জুন লালপুরের বিলমাড়িয়া গ্রামে খেতে বাদাম তোলার সময় চারটি রাসেলস ভাইপার দেখে শ্রমিকরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারেন। ২১ জুন রাজশাহীর পলাশি ফতেপুর গ্রামসংলগ্ন পদ্মার চরে পাট খেতে কাজ করার সময় দুটি রাসেলস ভাইপার দেখে পিটিয়ে মারেন গ্রামবাসী।
সর্বশেষ ২৪ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের আলালপুর গ্রামের আমবাগানে একটি রাসেলস ভাইপার দেখে লোকজন পিটিয়ে হত্যা করেন। নওগাঁতেও রাসেলস ভাইপার পিটিয়ে মারা একাধিক ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম বলেন, মানুষের মধ্যে সাপ আতঙ্ক রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে আতঙ্ক বেশি ছাড়ানো হয়েছে। সেই জায়গা থেকে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। তবে উপজেলার প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাষিদের জানানো হচ্ছে তারা যেন কৃষিকাজের সময় গামবুট ব্যবহার করেন। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনমের ব্যবস্থা রয়েছে।
গতকাল ১০জুলাই (বুধবার) দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কনফারেন্স রুমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন রাসেলস ভাইপার নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) আসা তথ্যানুসারে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত দেশে ৬১০টি সাপের কামড়ের তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া সাপের কামড়ে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি সাপে কাটা রোগী পাওয়া গেছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে চলতি বছরের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সাপের কামড়ে মোট ৪১৬ জন রোগী ভর্তি হয়, তার মধ্যে ‘বিষধর’ ৭৩টি এবং ১৮টি চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপ ছিল। সাপের কামড়ে আক্রান্তদের মধ্যে মোট ১১ জন রোগী মারা যান, এর মধ্যে চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ের কারণে মারা যায় ৫ জন।
তিনি আরও বলেন, দেশে সাপের দংশনে নীতিগতভাবে একটি স্বীকৃত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। ২০২২ সালে পরিচালিত জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ লাখের অধিক মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। যার মধ্যে দুঃখজনকভাবে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। সাপের বিষয়ে অপর্যাপ্ত তথ্য থাকা সত্ত্বেও প্রধান ‘বিষধর’ সাপের মধ্যে গোখরা, ক্রেইট, চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) ও সবুজ সাপ অন্যতম।
জ/ন