গোলাম তোফাজ্জল কবীর মিলন,বাঘা (রাজশাহী): মাধ্যমিকের গন্ডি না পেরুতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অপরিনত বয়সে প্রেমের ফাঁদে পড়ে বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীরা। এতে একদিকে বাড়ছে নিখোঁজের অভিযোগ অন্যদিকে বাড়ছে বাল্যবিবাহ। রাজশাহীর বাঘায় গত দেড়মাসে ২৬ জন ছাত্র-ছাত্রী পালিয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজনকে উদ্ধার করা হলেও বাবা-মার ঘরে ধরে রাখা যায়নি তাদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২৩ জুলাই, নিজ বাড়ি থেকে কেশবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় বাচ্চুর নবম শ্রেণীতে পড়––য়া ছাত্রী। বাড়িতে ফেরা না দেখে, একই উপজেলার হাবাসপুর গ্রামের কটার ছেলে সেলিম, ও মনিগ্রামের ফরমানের ছেলে রাজিবের বিরুদ্ধে ২৪ জুলাই (মঙ্গলবার) থানায় অপহরণের অভিযোগ করেন তার বাবা।
১৬ জুলাই মনিগ্রাম টেকনিক্যাল বিজনেস এন্ড ম্যানেজমেন্ট কলেজের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী মনিগ্রামের স্বাক্ষরজ্ঞান ছেলে সজলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। এখনো তাদের সন্ধান পাননি পরিবার।
১ জুলাই,অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা দিতে আসে ইসলামী একডেমী উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। সে আর বাড়িতে ফিরে না গিয়ে রাজশাহী পলিটেকনিক্যাল ইনিস্টিটিউট এর ছাত্রের সাথে বিয়ে করে। ছাত্রীর মা জানান, থানায় ছাত্রের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ করলেও মামলা রেকর্ড করা হয়নি।
একই তারিখে (১ জুলাই) আইএ পড়–ুয়া প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, দিঘা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এক ছাত্রী। তার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে ছেলের বাবাকে আটক করে পুলিশ। পরে পৌর মেয়র ও পুলিশ প্রশাসন ছাত্রীকে উদ্ধার করে বাবার জিম্মায় দেয় ও ছাত্রের বাবাকে ছেড়ে দেয়। ২৩ জুলাই রাতে আগের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে,পুলিশের এক এসআই এর সাথে বিয়ে দেন ছাত্রীর অভিভাবক। পরদিন পালিয়ে সেই প্রেমিকের কাছে চলে যায় ওই ছাত্রী। ১৮ জুলাই আড়ানি পৌর মেয়রের ছেলে,আড়ানীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর এক ছাত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে পরে ছাত্রীকে উদ্ধার করে তার বাবার জিম্মায় দেওয়া হয়।
১৪জুলাই তেথুলিয়া-পীরগাছা ভোকেশনাল ইন্সটিটিউট এন্ড বিএম কলেজের ছাত্র-ছাত্রী পালিয়ে যাওয়ার সময় তেপুকুরিয়া এলাকায় নজরে পড়ে ছাত্রীর বাবার । পরে নিজ নিজ অভিবাবক তাদের নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী আয়েব উদ্দীন এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
৩জুলাই রাজশাহী থেকে পালিয়ে বাঘায় গাওপাড়ার মহির মিস্ত্রির বাসায় উঠে জেলার খড়খড়ি গ্রামের আব্দুস সালামের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী ও একই গ্রামের আলা উদ্দীনের আইএ পড়–য়া ছাত্র। ইউএনও’র হস্তক্ষেপে তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হয়।
২৮জুন, প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে কলেজ পড়–য়া প্রেমিকের সাথে নিখোঁজ হয় ইসলামী একডেমী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ২৯ জুন,উপজেলা নির্বাহি অফিসার তাকে উদ্ধার করে ছাত্রীর বাবা-মার জিম্মায় দেন। ৩দিন পর ওই ছাত্রী আবারো পালিয়ে যায় তার প্রেমিকের কাছে ।
২৮ জুন আড়পাড়া গ্রামের স্কুল পড়–য়া বিবাহিত এক নারি, বিয়ের এক সপ্তাহ পর বাবার বাড়িতে এসে প্রেমিকের হাত ধরে নিখোঁজ হন। আগের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে পরে প্রেমিকের সাথেই বিয়ে করেন।
২৬ জুন, দিঘা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী, একই গ্রামের আইএ পড়–য়া ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। ২৫ জুন আড়ানী এফএন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আসার পর নিখোঁজ হয়, গোচর গ্রামের দশম শ্রেণীতে পড়–য়া ছাত্রী। তার মা, বাঘা ও বাগাতিপাড়া থানায় অপহরণের অভিযোগ করেও ছাত্রীকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। বাঘার পাশর্^বর্তী বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর গ্রামের জনি নামের এক বখাটে তার বন্ধুদের সহযোগিতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে বলে জানা যায়। এর আগেও স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়শঃ উত্ত্যক্ত করতো বলে জানান ছাত্রীর মা। ছাত্রীকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ বিশ হাজার টাকা দাবি করেছিল বলে জানান তিনি। ২৩জুন, হাট বাউসা গ্রামের কলেজ পড়–য়া ছাত্রী পালিয়ে যায় পাশের গ্রামের তার প্রেমিকের হাত ধরে। নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর বাবা-মা জানেন বিয়ে করে তারা ঢাকায় চলে গেছে।
২ মে, সুলতানপুর গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্রী মশিদপুর গ্রামের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬ জুলাই তাকে উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হলেও পিতার সাথে যেতে রাজ হয়নি ওই ছাত্রী। পরে আ’লীগ নেতার জিম্মায় দেয় পুলিশ। ৩১ মে থানায় এ অভিযোগ করেন তিনি । ২৮ মে হরিরামপুর গ্রামের চান্দুর ছেলে সুমন ভারতের মর্শিদাবাদের জলঙ্গির শহিদুলের মেয়ে আনোয়ারাকে বাংলাদেশে নিয়ে এনে বিয়ে করে। সুমন ভারতে কাজে গিয়ে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। ২৯ জুন নোটারি পাবলিক কার্যালয়,রাজশাহীতে এফিডেভিট এর মাধ্যমে বিয়ে করেন,হরিরামপুর গ্রামের শারমিন সুলতানা বৃষ্টি ও একই গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে তরিকুল।
অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, থানায় অভিযোগ করেও সেবা না পেয়ে কেউ কেউ আইনি সহায়তা চেয়ে ৩৩৩ ও ৯৯৯ নম্বরে জরুরি নাগরিক সেবায় যোগাযোগ করেছেন। ছাত্রী অভিভাবক বাচ্চু ও নিলা বেওয়া জানান,সেখান থেকেও ভালো কোন সাড়া মেলেনি।
মনোবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক মাহবুবুল আলম বলেন, অসংযত আবেগি মন, কিশোর কিশোরীদের পালিয়ে গিয়ে বাল্য বিয়ের মূল কারণ। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক,পর্নোগ্রাফি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল হাসান বলেন, প্রকৃতপক্ষে তারা অপহৃত হয়েছে কি-না,সে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে গিয়ে সাধারন ডায়রি করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে প্রেমের কারণেই তারা বাবা-মার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।
উপজেলা নির্বাহি অফিসার শাহিন রেজা জানান, যাদের উদ্ধার করা হয়েছে,তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। পরে কি হয়েছে তা জানেনা তিনি।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/জেএন
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পুর্ণ বেআইনি।