নাটোর প্রতিনিধিঃ দাদার স্বপ্নকে বুকে ধারন করে এগিয়ে যাচ্ছে মিথিলা। নাটোর শহরের মহারাজা জেএন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে ব্যয় করেছেন জীবনের প্রায় সমস্ত সময়। অথচ এই মহান ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে হয়েছে। আদর্শ শিক্ষকের আদর্শ সন্তানরা সেদিন মেনে নিতে পারেনি বাবার এমন মৃত্যু। বার বারই নিজেদের দিয়েছিল ধিক্কার। মনে মনে সংকল্প করেছিল, নিজেদের সন্তানদের ডাক্তার করে গড়ে তুলবে। কিন্তু ছয় ভাইয়ের কেউই পারেনি সে স্বপ্ন পূরণ করতে। অবশেষে ৫ম সন্তান নিজেকে বাবার মতই শিক্ষকতার পেশায় উৎসর্গ করেছেন। অবশেষে একদিন বড় সন্তান মিথিলাকে খুলে বলেন তার মনোকষ্ট আর সংকল্পের কথা। মিথিলা কথা দেয়। সে তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করবে। আর এজন্য ভাল রেজাল্টও ছিনিয়ে নিতে সে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হয় রাতের পর রাত জেগে মিথিলার অধ্যাবসায়। অবশেষে জীবনের প্রথম পদক্ষেপেই সে জয়ী হয়েছে। নাটোর সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পাশাপাশি সে পেয়েছে বৃত্তি। সন্তানের প্রত্যাশিত ফলাফল আর সংকল্প পথে এগিয়ে যাওয়া দেখে আজ তাই বাবা-মার চোখে আনন্দের অশ্রু।
মিথিলার বাবা, সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া পিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মমতাজ-উল-আলম মুকুল জানান,তার বাবা (মিথিলার দাদা) মোজাম্মেল হোসেন ছিলেন, শহরের বিখ্যাত মহারাজা জেএন উচ্চ বিদ্যালয়ের নিবেদিত শিক্ষক। সারা জীবন ধরে তিনি শিক্ষার্থীদের সঠিক মানুষ হিসেবে গড়তে নিজের সমস্ত মেধা ব্যায় করেছেন। বাবার হাতে গড়া অনেক শিক্ষার্থী বড় বড় অফিসার হয়ে নিজের জীবনকে ধন্য করেছেন। হয়েছেন স্বাবলম্বী। অথচ তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন ২০০৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাকে উপযুক্ত চিকিৎসা করানোর খরচ তাদের ছিল না। এক পর্যায়ে নাটোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
মুকুল বলেন, বাবার মৃত্যু কেউ সেদিন মেনে নিতে পারেনি। ডাক্তার বলেছিলেন, বাবাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অথবা কোন হৃদরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করাতে। কিন্তু টাকার অভাবে তা করা যায়নি। চোখের সামনে বাধ্য হয়ে সেদিন দেখতে হয়েছে ত্যাগী-মহান বাবার মৃত্যু।
মুকুল আরো বলেন, বাবার মৃত্যুর কথা তারা আজও ভুলতে পারেননি। বাবার মৃত্যুর পর তারা ছয় ভাই সংকল্প করেছিলেন, নিজেদের সন্তানদের ডাক্তার বানাবেন। যাতে বাবার মত আর কোন ত্যাগী ব্যক্তিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে না হয়। কিন্তু কোন ভাই তা পারেননি। অবশেষে তিনি দিঘাপতিয়া পিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে বাবার আদর্শকে লালন করতে থাকেন। একদিন মেয়ে মিথিলাকে মনোকষ্ট বলার পর মেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল স্বপ্ন পূরণের। সে জানিয়েছিল, নিজেকে ভাল ফলাফলে এগিয়ে নিয়ে সে ডাক্তার হবে। জীবনের প্রথম জাতীয় পরীক্ষায় (প্রাথমিক সমাপনী) সে নাটোর সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ অজর্ন ছাড়াও বৃত্তি পেয়েছে। স্বপ্ন পূরণের পথে মেয়ে অগ্রসর হতে থাকায় তারা আনন্দে আত্মহারা।
মিথিলা জানায়, প্রাথমিক সমাপনীর মত জেএসসি, এসএসসিসহ জীবনের সকল পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে সে ডাক্তারী পড়তে চায়। নিজেকে ড্ক্তাার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করার পাশাপাশি সে নিজ অর্থ ব্যয়ে সমাজের নিপিড়িত মানুষদের চিকিৎসাসেবা দিতে চায়। যাতে আর কোন মানুষকে তার দাদার মত প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে না হয় সেজন্য কাজ করাকেই জীবনের ব্রত করেছে মিথিলা।
এক প্রশ্নের জবাবে মিথিলার মা আনোয়ারা বেগম জানান, তাদের দু মেয়ে। মিথিলা-ই-জান্নাত আর ছোটটির নাম মেধা-ই-জান্নাত। দুই মেয়েই তাদের নয়নের মণি। মেয়ে মিথিলা রাত ১২টার আগে কখনও ঘুমোতে যায় না। ভাল ফলাফলের জন্য মেয়ের এই উৎসাহ আর পরীশ্রমকে সম্মান জানিয়ে তিনি মেয়ের পাশে বসে তাকে মানসিকভাবে সাহস দেন।
মিথিলার ভাল ফলাফলের জন্য মেয়ের পরীশ্রমকেই কারণ হিসেবে জানিয়ে বাবা মমতাজ-উল-আলম জানান, মিথিলার ভাল ফলাফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও অনেক অবদান রয়েছে। মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি সকলের দোয়া কামনা করেন।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ