বিভুরঞ্জন সরকার: ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারা পরস্পর কুশল বিনিময় করেছেন। এটা কোনো পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির অংশ ছিল না। চলতি পথে হঠাৎ দেখা। সামান্য সৌজন্য বিনিময়। তবে একটু বেশি হলে কোনো ক্ষতি ছিল না। গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল, একই ফ্লাইটে দুই দলের দুই নেতা ঢাকা থেকে সৈয়দপুর যাবেন। কিন্তু এক ফ্লাইটে তারা যাননি। মির্জা আলমগীর ফ্লাইটের সময় বদলেছিলেন।
বলা হয়েছে, তার স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে তিনি ফ্লাইটের সময় পরিবর্তন করেন। আসলে কি তাই? নাকি এক ফ্লাইটে যাওয়ার অস্বস্তি এড়ানোর জন্যই তা করা হয়েছিল? আমরা এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমাদের রাজনীতিবিদদের মনের কথা জানা সহজ নয়। তাদের মনের কথা এবং মুখের কথা অনেক সময়ই এক হয় না।
ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা আলমগীর এক বিমানে আধা ঘণ্টা ভ্রমণ করলে হয়তো তারা একটু মত বিনিময় করতে পারতেন। তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়ায় যে জড়তা তৈরি হয়েছে তা হয়তো কাটতে পারতো। সেটা না হলেও সৈয়দপুর বিমানবন্দরেই দুই নেতার দেখা হয়েছে। দু’চারটা কথাও হয়েছে। এটা মন্দের ভালো।
ওবায়দুল কাদের বিমানবন্দরের ভিআইপি রুমে ঢাকা ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিএনপি মহাসচিবও বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছেন শুনে ওবায়দুল কাদেরই তার কাছে এগিয়ে যান এবং কথা বলেন। মির্জা আলমগীর ঘটনার আকস্মিকতায় হয়তো বিমূঢ় হয়েছেন। কিন্তু সৌজন্য বিনিময় না করে উপায় ছিল না। তাদের এই দেখা হওয়া এবং কথা বলার বিষয়টি গণমাধ্যমে খবর হয়েছে। একটি দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে কথা বলা, দেখা হওয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা বা ‘খবর’ হওয়ার মতো বিষয় না হলেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় এটা একটি খবর বৈকি!
তবে এই খবর মানুষের মধ্যে বিশেষ কোনো আশাবাদ তৈরি করেনি। এতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি হয়েছে – মনে করারও কোনো কারণ নেই। আমাদের দুই প্রদান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ঈদের সময় শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করেন কিন্তু সম্পর্কের শীতলতা তাতে দূর হয় না। ওটা এখন একটি নিছক আনুষ্ঠানিকতামাত্র।
তবে দুই দলের নেতাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক দেখা-সাক্ষাৎ নিয়মিত হলে বরফ গলার মতো অবস্থা হয়তো হতো। সরাসরি কথাবার্তা হলে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে বা কমাতে চান না বলেই সম্ভবত আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সামাজিক বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানগুলোতেও কাছাকাছি হওয়ার গরজ বোধ করেন না।
সরকারের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠানের কথা বিএনপির পক্ষ থেকে ইদানীং প্রায়ই বলা হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের পরিবেশ নষ্ট করার জন্য বিএনপির ওপর দোষারোপ করা হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে কি একবারও জানা-বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যে কেন আওয়ামী লীগ এমন অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে করে?
বিএনপি নেতারা হয়তো মুখস্ত বলবেন, পরিবেশ নষ্ট করছে সরকার। সরকার বিএনপিকে চাপের মধ্যে রেখেছে। মামলা-হামলায় বিএনপি জর্জরিত। বিএনপির এই বক্তব্য হয়তো ভুল নয়। সরকার বা আওয়ামী লীগ কেন তাদের ওপর এত বিরূপ সেটা বিএনপিকে বুঝতে হবে। বিএনপি এতদিন মনে করেছিল, আন্দোলন করেই তারা সরকারকে দুর্বল করতে পারবে।
এমনকি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের স্বপ্নও তারা দেখেছে। আন্দোলনের নামে চরম সহিংসতা চালিয়েও বিএনপি সরকাকে কাবু করতে পারেনি, বরং সরকার বিএনপির ব্যাপারে আরও কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছে। সরকার যেহেতু ক্ষমতায় এবং দৃশ্যত তাদের অবস্থান এখন পর্যন্ত দুর্বল নয়, সেহেতু গরম কথা বলে বিএনপি খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ সব মিলিয়ে বিএনপির অবস্থান এখন দুর্বল।
বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলে এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য তাদের কোনো নমনীয়তা নেই। বক্তৃতা দিতে গেলেই বিএনপি নেতারা এমন সব কথা বলেন যাতে মনে হয়, তারাই ক্ষমতাসীন দল আর আওয়ামী লীগ আছে বিরোধী দলে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ সেদিনও সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামানোর কথা বলেছেন।
এসব হুমকি সরকার কেন সহজভাবে নেবে? বিএনপির যেমন ক্ষমতায় যাওয়ার তাগিদ-তাড়া আছে, তেমনি আওয়ামী লীগেরও ক্ষমতায় থাকার আগ্রহ আছে। বিএনপির যেমন জনসমর্থন আছে, তেমনি আওয়ামী লীগও একেবারে জনসমর্থনশূন্য নয়। গণজমায়েতের ক্ষমতা দুই দলেরই প্রায় সমান সমান। সব দিক বিবেচনা করেই বিএনপির রাজনীতি ঠিক করা উচিত।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুখে বলছেন, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ‘মাফ’ করার কথা, প্রতিহিংসামূলক আচরণ না করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। তার সব বক্তৃতাই আক্রমণাত্মক। চরম আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী। তিনি যেহেতু বাকসংযমের পরিচয় দেন না, সেহেতু আওয়ামী লীগও ছাড় দেয় না। ঢিল-পাটকেলের নীতি থেকে একপক্ষকে বিরত থেকে অন্যপক্ষকে সেটা অনুসরণের আহ্বান জানাতে হবে।
বিএনপি যদি মনে করে আওয়ামী লীগ প্রথম অস্ত্রবিরতি করবে তাহলে সেটা কখনই হবে না। আওয়ামী লীগ এটা একাধিকবার প্রমাণ করেছে যে তারা রাজনৈতিক কৌশলের খেলায় বিএনপি থেকে এগিয়ে আছে। আর যারা এগিয়ে থাকে তারা কখনও আত্মসমর্পণ করে না।
দুই.
গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকে বিএনপি কি খুব ভালো করেছে? বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনা প্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান মনে করেন, বিএনপি সেনাকুঞ্জের দাওয়াতে না গিয়ে ভুল করেছে। তিনি নিজে প্রতিবার উপস্থিত থাকলেও এবার যেতে পারেননি চোখের অপারেশনের কারণে। কিন্তু দলের চেয়ারপারসন এবং মহাসচিবের একজন অন্তত উপস্থিত থাকতে পারতেন।
তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হতো না। তারা অনুপস্থিত থেকে সরকারকে অস্বস্তি দেওয়ার নামে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি কি একধরনের অনীহা দেখালেন না? সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মতো নয়। সশস্ত্র বাহিনী কোনো দল বা সরকারের প্রতিষ্ঠান নয়। সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, অখণ্ডতা, গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক। বিএনপি এক সময় নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে একাত্ম অনুভব করতো। এখন তারা সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠান বয়কট করায় মানুষ কি বার্তা পেলো?
পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, সেনাকুঞ্জে যাওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল বিএনপির। কিন্তু শেষ মুহূর্তে লন্ডন থেকে তারেক রহমানের সবুজ সংকেত না পেয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। তারেক রহমানকে বিএনপি তাদের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি বানিয়ে যে খুব ভালো কাজ করেনি, এটাও বিএনপি নেতৃত্ব এখনও বুঝতে পারছেন না।
বেগম জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই তারেক রহমানও গ্রহণযোগ্য হবেন – এটা যারা ভাবেন বা মনে করেন তাদের রাজনৈতিক বুঝ গ্রাম্য মাতব্বরের চেয়ে বেশি নয়। তারেক রহমানের রাজনীতিকে ‘বিপজ্জনক’ বলেই মনে করা হয়।
তার দেশি-বিদেশি কানেকশন মোটেও সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে নয় বলেই অনেকে মনে করেন। রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়ে তিনি সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার সঙ্গে জড়িয়েছেন বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। দেশে থাকতেও তিনি দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। তার হাওয়া ভবনের ভীতি এখনও অনেকের মনেই জীবন্ত রয়েছে।
বেগম জিয়া পুত্র স্নেহ অন্ধ বলেই তারেককে তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বানানোর চেষ্টা করছেন। এটা করে তিনি নিজের এবং বিএনপির খুব উপকার যে করেননি তা যখন দলের সবাই বুঝবেন, তখন হয়তো তাদের আর সংশোধনের সুযোগ থাকবে না। দেশে একটি নির্বাচন আসছে।
কোনো অজুহাতেই ওই নির্বাচন থেকে দূরে থাকা বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন না। কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে – সেটাকে বড় ইস্যু করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাময়িক উত্তেজনা হয়তো তৈরি করা যাবে কিন্তু তাতে দেশ-গণতন্ত্র-দল কারো বিশেষ কোনো লাভ হওয়ার কোনো কারণ দেখা যায় না।
রাজনীতিতে কৌশলের খেলা খেলতে গিয়ে বিএনপির এমন জাল বিছানো উচিত হবে না, যে জাল গুটিয়ে আনার সক্ষমতা তাদের নেই।
বিভুরঞ্জন সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
bibhu54@yahoo.com