আজহারুল ইসলাম বুলবুল : রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক সদস্য দীর্ঘদিন আরএমপিতে থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে অর্থের বিনিময়ে মাদক কেনাবেচায় সহায়তা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। খবর ২৪ ঘন্টার অনুসন্ধানে জানা গেছে বিষ্ময়কর তথ্য । অনেক এএসআই থেকে এসআই যুগ পার করেছেন এই ইউনিটে। আরএমপি থেকে তাদের বদলি করা হলেও তারা সেই বদলি কাটিয়ে আবার রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশে থেকে যান। এমনও পুলিশ সদস্য রয়েছেন যারা আরএমপিতে পুলিশ কন্সটেবল থেকে এসআই হয়েছেন। তারা মাঝে দুই/এক বছর বাইরে থেকে আবার ফিরেন আরএমপিতে। বদলি ঠেকিয়ে বছরের পর বছর থাকছেন তারা। কেনই বা তাদের কাছে আরএমপি এত পছন্দের ইউনিট বা কেনই বা তারা এই শহরে থাকতে চান? এসব বিষয়ে খবর ২৪ ঘণ্টার
পক্ষ থেকে খোঁজ নেয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আরএমপির কিছু পুলিশ সদস্য দীর্ঘদিন ধরে এ ইউনিটেই রয়েছেন। আর এখানে থাকার সুবাধে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। এদের মধ্যে কেউ কেউ অপরাধীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরপর চলে তাদের অসাধু কাজ। এসব বিষয় নিয়ে তদন্তে নেমেছে সরকারের দুটি উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তারা বলেন, কিছু পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠার পর আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।
যেসব পুলিশ সদস্য দীর্ঘ সময় ধরে আরএমপিতে রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার এসআই (নিঃ) মো. গোলাম মোস্তফা বিপি নম্বর-৮৪০৪০৮৩২৭৬, নিজ জেলা রাজশাহী । ২০০৪ সালে তিনি পুলিশ কন্সটেবল পদে যোগদান করেন। তিনি আরএমপিতে আসেন ২০০৭ সালের ২৪ মে। এএসআই পদে পদোন্নতি পান ২০১২ সালের ৭ জুলাই। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারী এসআই
পদে পদোন্নতি পান। তিনি আরএমপির পিওএম বিভাগে ছিলেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে ছিলেন ২০১২ সাল পর্যন্ত। বোয়ালিয়া মডেল থানায় যোগদান করেন ২০১২ সালের ১৫ জুলাই। তিনি সেখানে থাকেন ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারী তিনি আবার বোয়ালিয়া মডেল থানায় এসআই হিসেবে যোগদান করেন। এরপর থেকে তিনি বোয়ালিয়া থানায় কর্মরত রয়েছেন। চাকুরী জীবনের ১০ বছরই তিনি আরএমপিতে কর্মরত রয়েছেন। এ থানায় যোগদানের পর থেকেই তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। দীর্ঘদিন এক থানায় থাকার সুবাধে সিনিয়র কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অর্থ বাণিজ্য শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে তিনি
দীর্ঘদিন আরএমপিতে থাকার সুবাধে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলাসহ মাদক কেনাবেচায় সহায়তা ও ওয়ারেন্ট তামিল করতে উৎকোচ গ্রহণ করে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এক থানা থেকে অন্য থানা রাজপাড়ার তেরখাদিয়া ডাবতলা এলাকার বাক্কারের বাড়িতে গত ২২ মার্চ
গভীর রাতে প্রবেশ করে বিনা কারণেই হয়রানি করেন ও ভাংচুর করেন জিনিসপত্র। ভুক্তভোগী পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি বলেও খবর ২৪ ঘণ্টাকে জানিয়েছে। বোয়ালিয়া মডেল থানার আরেক এসআই (নিঃ) উত্তম কুমার রায়, বিপি নং-৮৬০৫০৯৯১৪৯ । তিনি পুলিশ কন্সটেবল পদে ২০০৫ সালের ৭ আগস্ট চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি প্রথম আরএমপিতে যোগদান করেন ২০০৫ সালের ৭ আগস্ট। তিনি এএসআই পদে পদোন্নতি পান ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এসআই পদে পদোন্নতি পান ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর। আরএমপির বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বোয়ালিয়া মডেল থানায় ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারী থেকে এ পর্যন্ত কর্মরত
রয়েছেন। এএসআই থেকে এসআই পর্যন্ত তিনি এ থানায় কর্মরত। প্রায় ১৩ বছর ধরে তিনি আরএমপিতে রয়েছেন। মাঝখানে বদলি হয়ে গেলেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে আরএমপিতে ফেরেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকার কারণে সমাজের খারাপ লোকজনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলাসহ থানার সিভিল টিমে অবৈধ অপারেশনাল কাজ, ওয়ারেন্ট তামিলে উৎকোচ গ্রহণ ও মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়কারীদের সাথে জড়িত। এএসআই থাকাকালে তিনি সিনিয়র অফিসারদের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
এসআই মো. সেলিম রেজা (নিঃ), বিপি নম্বর-৭৪৯৫০০০১৮৫, মতিহার থানা। নিজ জেলা গোদাগাড়ী , রাজশাহী। তিনি ১৯৯৫ সালের ২৯ জুলাই কন্সটেবল পদে চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি ২০০৯ সালের ১৭ জুন আরএমপিতে যোগদান করেন। এএসআই পদে পদোন্নতি পান ২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর। এসআই পদে পদোন্নতি পান ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারী। আরএমপিতে তিনি গোয়েন্দা শাখা, সিটিএসবি,
মেট্রেকোট, মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ি, সিটিএসবি, বোয়ালিয়া মডেল থানা, বেলপুকুর থানায় কর্মরত ছিলেন । বর্তমানে তিনি মতিহার থানায় কর্মরত রয়েছেন। তিনি আরএমপিতে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি এক ইউনিটেই দীর্ঘদিন থাকার সুবাধে মাদক ব্যবসায়ী ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে পড়েন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাবারক হোসেন এসআই (নিঃ) , বিপি নং-৭২৯২০৫০১৬৩ , নিজ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তিনি ১৯৯২ সালের ৫ নভেম্বর । আরএমপিতে যোগদান করেন ১৯৯২ সালের ৬ নভেম্বর। তার প্রথম কর্মস্থল আরএমপি। এএসআই পদে পদোন্নতি পান ২০০৩ সালের ১৬ এপ্রিল । চাকুরী জীবনের ২৮ বছরের মধ্যে ১৮ বছরই তিনি আরএমপিতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানেও তিনি আরএমপির এয়ারপোর্ট থানায় কর্মরত রয়েছেন। আরএমপিতে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। আরো-ওয়ান থাকাকালীন তিনি অসাধু বেশ কিছু পুলিশ সদস্যদের পোস্টিংয়ে সহযোগিতা করে উৎকোচ গ্রহণ করাসহ নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
এসআই (নিঃ) আব্দুর রশিদ, বিপি নং-৭৯৯৮০৫০৫৮২ , নিজ জেলা লালমনিরহাট । চাকুরীতে কন্সটেবল পদে যোগদান করেন ১৯৯৮ সালের ২৬ মে। আরএমপিতে যোগদান করেন ২০০৩ সালের ১৬ মে। এএসআই পদে পদোন্নতি পান ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট। এসআই পদে পদোন্নতি পান ২০১৬
সালের ৩ নভেম্বর। তিনি ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত আরএমপিতে কর্মরত রয়েছেন। ২০০৯ সালের ১১ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত আরএমপির কেন্দ্রীয় রিজার্ভ অফিসে আরো-টু হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। দীর্ঘদিন আরএমপির রিজার্ভ অফিসে থাকার সুবাধে সরকারী কোয়ার্টার অন্যের নামে বরাদ্দ করে নিজে স্ব-পরিবারে বসবাস করার অভিযোগ রয়েছে। পোস্টিং করতে সহযোগিতার কথা বলে সিনিয়র অফিসারদের নামে উৎকোচ গ্রহণেরও অভিযোগ উঠেছে।
রাজপাড়া থানার এসআই শরিফুল ইসলাম (নিঃ), বিপি নং-৭৮৯৮০৫১০৯২ , নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ। তিনি ১৯৯৮ সালের ৬ জুন কন্সটেবল পদে চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে আরএমপিতে যোগদান করেন। এএসআই পদে পদোন্নতি পান ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট। এসআই পদে পদোন্নতি পান ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর। তিনি চাকুরী জীবনের ২২ বছরের দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে আরএমপিতেই কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি রাজপাড়া থানায় কর্মরত রয়েছেন। তিনি আরএমপির এসএএফ শাখা, রাজপাড়া থানা, রাজশাহী কলেজ ফাঁড়ি, গোয়েন্দা শাখা, রাজপাড়া থানা, বোয়ালিয়া মডেল থানা ও বর্তমানে রাজপাড়া থানা। ১৭ বছরের প্রায় ১ যুগ তিনি রাজপাড়া
থানায় কর্মরত রয়েছেন। তিনি ওয়ারেন্ট অফিসার এর দায়িত্ব পালন করায় অসাধু স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলাসহ মাদক ব্যবসায়ীদের মাদক কেনাবেচায় সহায়তা ও ওয়ারেন্ট তামিলের নামে উৎকোচ গ্রহণ। এ ছাড়াও আরো একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়াও বেলপুকুর থানার শফিকুল ইসলাম, বিপি নং-৮২০২০১৮৭৯ । স্থানীয়দের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে , তিনি থানা এলাকার অনেক অসহায় মানুষকে বিনা কারণে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করেন। এএসআই মাহবুব রাজপাড়া থানায় কন্সটেবল থেকে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই পর্যন্ত ৬ বছর ধরে একই থানায় কর্মরত রয়েছেন। এএসআই কামরুজ্জামান বেলপুকুর থানা, বিপি নং-৭৪৯৫০৫০৫৭৯ । নিজ উপজেলা দুর্গাপুর। আরএমপিতে কয়েক বছর ধরে রয়েছেন।
মতিহার থানার এসআই টিএম সেলিম ও রাজপাড়া থানার এসআই মোতালেব। এ দুইজনই দীর্ঘদিন ধরে আরএমপিতে রয়েছেন। তারা একই থানায়ও রয়েছেন বেশ কয়েক বছর। বায়া পুলিশ ফাঁড়ির টিএসআই
হানিফ। টিএসআই হানিফও দীর্ঘ সময় ধরে আরএমপিতে রয়েছেন। অপরাধীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে নামে বেনামে অনেক সম্পদের মালিক বনে গেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি যুগ পার করেছেন আরএমপিতে। অন্য এসআইদের মধ্যে অনেকের ৫ থেকে ৭ বছর পার হয়েছে আরএমপিতে।
টিএসআই মনিরুল ইসলাম, নিজ বাড়ি রাজশাহী কোর্ট স্টেশন। দীর্ঘদিন ধরে হাবিলদার হিসেবে মহানগরীর কাশিয়াডাঙ্গাসহ গুরুত্বপূর্ণ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাঝখানে তিনি পদোন্নতি নিয়ে চলে যান। বর্তমানে তিনি আবারো আরএমপিতে যোগদান করেন। বর্তমানে মাদক স্পট হিসেবে পরিচিত বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই ফাঁড়ির এএসআই ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে অর্থেও বিনিময়ে মাদক কেনাবেচায় সহায়তা করছেন বলে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। এএসআই ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়াটার্স (এআইজি)
জালাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত আরএমপির কমিশনারকে মাদক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, করোনাকালে অনেক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবার কেউ কোন কোন অসাধু পুলিশ সদস্য গ্রেফতার বাণিজ্য, গ্রেফতার পরোয়ানা তামিল না করা, মামলার নামে হয়রানি, এমনকি মাদক কারবারে যুক্ত হয়েছেন কেউ কেউ। আর এসবই করছেন টাকার বিনিময়ে। কেউ কেউ নামে বেনামে গড়েছেন সম্পদ। আর এসবের মায়ায় ছাড়তে পারছেন না আরএমপি। অন্য কোথাও বদলি হলে তদবির করে আরএমপিতে ফেরেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার কওে
সংশ্লিষ্ট এসআই ও এএসআইরা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও কোন অপরাধের সাথে জড়িত নই। আমাদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ সঠিক নয়। হয়তো কেউ ভুল তথ্য দিয়ে থাকতে পারে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বোয়ালিয়া জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সাজেদুল ইসলাম বলেন, আমি অসুস্থ। সুস্থ বিষয়গুলো খোঁজ নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে আরএমপির মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, কারো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক স্থানে বেশি সময় থাকলে বিভাগীয় কোন সমস্যা নেই। তবে অপরাধ করলে কোনভাবে ছাড় দেয়া হবে না। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আর/এস