খবর২৪ঘন্টা নিউজ ডেস্ক: তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাজারে কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে সক্ষমতার জানান দিয়ে আসছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। অবশেষে দেশটির রপ্তানি কৌশলের কাছে হার মানল মেইড ইন বাংলাদেশ। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে ভিয়েতনাম এখন দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দুই দেশের রপ্তানি আয়ের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে এই তথ্য।
গেল অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে তৈরি পোশাক থেকে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় এসেছে ৩০ বিলিয়ন ৯১ কোটি ডলার আর বাংলাদেশের এসেছে ২৭ বিলিয়ন ৯৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনামের আয় প্রায় ৩ বিলিয়ন (২৯৬ কোটি ডলার) ডলার বেশি। মাসভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গেল অর্থবছরের জুলাই, জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাত্র এই তিন মাসে পোশাক খাত থেকে ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি রপ্তানি আয় করেছে বাংলাদেশ। গেল অর্থবছরের মোট হিসাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় কমেছে আগের বছরের চেয়ে ১৮.১২ শতাংশ। গতি হারিয়েছে ভিয়েতনামও। দেশটির রপ্তানি কমেছে আগের এক বছরের চেয়ে ৩.০৯ শতাংশ।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করে প্রায় ৩৩১ কোটি ডলার। ওই মাসে এই খাত থেকে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় আসে ৩২৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ওই মাসে ভিয়েতনামের চেয়ে ১ কোটি ৩ লাখ ডলার এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। এর পরের মাস আগস্টে বাংলাদেশের আয় নেমে আসে ২৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলারে; সেখানে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ভিয়েতনামের আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে। অর্থাৎ এ মাসে ৯৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার এগিয়ে যায় ভিয়েতনাম। সেপ্টেম্বরে এসে পরস্পরের কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলা এই দুই দেশের রপ্তানি আয়ই খানিকটা কমে আসে। এ মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয় ২৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলার আর ভিয়েতনামের হয় ২৮৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ মাসেও বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ কোটি ৪০ লাখ ডলার এগিয়ে থাকে ভিয়েতনামের আয়। অক্টোবরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়লেও কমতির দিকেই থাকে ভিয়েতনাম। এ মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আসে ২৫২ কোটি ডলার; আর ভিয়েতনামের আসে ২৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ মাসে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ালেও ১৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার এগিয়েই থাকে ভিয়েতনাম। নভেম্বরে ভিয়েতনামের তেরি পোশাক থেকে রপ্তানি আয় আসে ২৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর কাছাকাছি থাকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়। সে মাসে বাংলাদেশের আয় ২৫১ কোটি ১০ লাখ ডলার। ডিসেম্বরে এসে বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ঘুরে দাঁড়ায় ভিয়েতনামও। ওই মাসে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ২৯৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশের আসে এর থেকে ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার কম (২৯৩৫ মিলিয়ন ডলার)।
পোশাক রপ্তানির আয়ে লাগাতার ৫ মাস পেছনে থাকলেও চলতি বছরের প্রথম মাসেই ভিয়েতনামকে আবার টপকে যায় বাংলাদেশ। জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়ায় ৩০৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারে; সেখানে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় আসে ২৪৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ ওই মাসে ভিয়েতনামের চেয়ে ৫৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার বেশি থাকে বাংলাদেশের আয়। পরের মাসেও এগিয়ে থাকে বাংলাদেশ। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২৭৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার আর ভিয়েতনামের ২২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার; যা বাংলাদেশের চেয়ে ৫৬ কোটি ডলার কম। এর পরের কয়েক মাস আর ভিয়েতনামের ওপরে থাকতে পারেনি বাংলাদেশ। মার্চে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় নেমে আসে ২২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারে আর ভিয়েতনামের হয় ২৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। করোনায় ধাক্কায় এপ্রিলে এসে রপ্তানি বাজারে নাস্তানাবুদ হয় বাংলাদেশের পোশাক। ওই মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় আসে মাত্র ৩৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। সে মাসেও মোটামুটি বাজারে টিকে থেকে ১৬১ কোটি ডলার রপ্তানি আয় ঘরে তুলে ভিয়েতনাম। এক মাসেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে ১২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা সোয়া বিলিয়ন ডলার। পরের মাসেই করোনার ধাক্কা সামলে উঠার ইঙ্গিত পাওয়া দুই দেশেরই রপ্তানি আয়ে। মে মাসে এই খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করে ১২৩ কোটি ১০ লাখ ডলার আর ভিয়েতনাম করে ১৮৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। আর গেল অর্থবছরের শেষ মাস জুনে এসে বাংলাদেশ, পোশাকের রপ্তানি বাজার থেকে আয় করে ২২৪ কোটি ডলার। ওই মাসে ভিয়েতনাম করে ২৬৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ২য় থেকে নেমে এল ৩য় স্থানে। আর ৩য় অবস্থান থেকে ২ নম্বরে উঠে গেল ভিয়েতনাম। তবে, এই দুই প্রতিযোগী দেশের চেয়ে ৫ গুন বেশি বাজার দখল করে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনই রয়েছে শীর্ষস্থানে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, নতুন নতুন বাজার ও বাজারের চাহিদা মতো নতুন নতুন পণ্য নিয়ে কাজ না করলে এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। সংগঠনটির মুখপাত্র (জনসংযোগ কমিটির চেয়ারম্যান) খান মনিরুল আলম শুভ জানান, কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে ভিয়েতনামে আমাদের মতো এত সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হয়নি। বাজারে ভিয়েতনামই বাংলাদেশের মূল প্রতিযোগী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভিয়েতনামের করা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) কার্যকর হলে আরও সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যাবে তারা। আমাদের এখন উপায় হল পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণে জোর দেয়া। বিজিএমইএ গত এক বছর ধরেই এই চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের মুদ্রা বিনিময় হারও রপ্তানি শিল্পের সহযোগী করা দরকার। এই মুদ্রা বিনিময় হারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত ও পাকিস্তান এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি যৌক্তিক কারণ তুলে ধরেন নীট পোশাক প্রস্তুতিকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটির পোশাক খাতে বেশিরভাগ বিনিয়োগই চীনাদের। ভিয়েতনামের এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে এটি বড় ভূমিকা রেখে আসছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী। এছাড়া, পণ্য সরবরাহে চীনের লিড টাইমও বাংলাদেশের চেয়ে বেশ কম। ভিয়েতনাম বাজার দখল কৌশল কাজে লাগিয়ে যেসব দেশে তাদের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ছিল না সে সব দেশের অনেকগুলোর সঙ্গে তারা এফটিএ করেছে।
এ অবস্থায় ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে বরাবরের মতো এবারও সরকারের কাছ থেকে নীতি সহায়তা চান তার। বিকেএমইএ’র এই নেতা জানান, বর্তমানে তারা যে ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনার চেয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম দামে আসছে। যা তারা নিতে পারছেন না। এক্ষেত্রে ঋণ সুবিধা যেমন দরকার তেমনি দরকার এফওবি’তে দেয়া নগদ সহায়তা প্রাপ্তিটাও সহজ করা।
করোনা পরবর্তী সময়ে রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশকে দাপট দেখাতে হলে আর এমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে না হয় সেদিক খেয়াল রাখতে হবে সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে জোটবদ্ধ বাণিজ্য সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) করার ব্যাপারে জোর দেয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস’র (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ। সম্প্রতি চীনে পাওয়া বাণিজ্য সুবিধার আওতায় যেন সব ধরনের পোশাক পণ্য থাকে তা নিশ্চিত করারও তাগিদ দেন তিনি।
বাংলাদেশে কোন খাতেই বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে তেমন কাজ করা হয় না উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম (গবেষণা পরিচালক, সিপিডি) বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগ বাংলাদেশে টানতে পারলে এবং সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা সম্পন্ন পণ্য প্রস্তুতির ওপর জোর দিতে হবে। পরিবর্তনশীল বাজারে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় ক্রেতার চাহিদাকে মাথায় রেখে রকমারি পণ্য তৈরিতে উদ্যোক্তাদের কৌশলী হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে, গত মাসের শেষ দিকে বিজিএমইএ জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোতে সক্ষমতার মাত্র ৩৫-৪০ শতাংশ কার্যাদেশ রয়েছে।
খবর২৪ঘন্টা/নই