ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে আট পর্বের ভোটগ্রহণ শেষে ফলাফল ঘোষণা হতে যাচ্ছে রোববার (২ মে)। ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যটি দখলে রাখতে পারবে, নাকি তাদের হটিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রথমবারের মতো পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবে, সে দিকেই এখন সবার নজর।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই ভোট গণনা হবে দেশের আরও চারটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের। রাজ্যগুলো হলো- তামিলনাড়ু, কেরালা, পুডুচেরি ও আসাম। সর্বভারতীয় পর্যাও মিডিয়ার যাবতীয় মনোযোগ যেন শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কেন্দ্রীভূত।
বিজেপি বলেই রেখেছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে তারা এখানে এনআরসি চালু করবে। মুসলিমদের লক্ষ্য করে আসামে এনআরসি অভিযান চালিয়ে যেভাবে তারা সে রাজ্যে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে পাকাপাকি বিভাজন সেরে ফেলেছে, একই জিনিস যে এখানেও হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?
প্রায় নয় কোটি জনসংখ্যার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এই ভোট শুধু যে ২৯৪ জন প্রতিনিধিকে নির্বাচন করবে তাই নয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজ্যের সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক চরিত্রেও সম্ভবত একটা বড়সড় পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারে এই ভোটের ফলে।
ভারতের জনসংখ্যায় মুসলিমদের যে শতকরা হার, তার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সেই অনুপাত প্রায় দ্বিগুণ। ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে রাজ্যের মুসলিমরা গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে সমানভাবে ছড়িয়ে আছেন তা নয়, মূলত মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া বা দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো চার-পাঁচটি জেলাতেই তাদের ভোটার বেশি।
ইতিহাসবিদ ও গবেষক কিংশুক চ্যাটার্জির মতে, ‘অন্যান্য রাজ্যের অভিজ্ঞতা দেখলে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে এখানে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ আর আগের মতো থাকবে না!’
বিজেপির ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা একের পর এক বলছেন, ‘মমতা ব্যানার্জি এতদিন ভোটে জিতেছেন স্রেফ রোহিঙ্গা আর বাংলাদেশিদের ভোটে’। মুসলিম কথাটা উচ্চারণ না-করলেও তারা যে এর মাধ্যমে আসলে কী বলতে চেয়েছেন, সেটা কারও বুঝতেই অসুবিধা হয়নি।
যে দলের নীতিই হলো এয়ার ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে ভারত পেট্রোলিয়াম—রাষ্ট্রের সব সম্পদ পারলেই বেচে দাও, তারা যে এ রাজ্যে ঢুকলে পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্ব আম্বানি-আদানিদের হাতে তুলে দেবে এটা মানুষ ভালো করেই জানে
অধ্যাপক রওশন জাহানারার আশঙ্কা, ‘বিজেপি বলেই রেখেছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে তারা এখানে এনআরসি চালু করবে। মুসলিমদের লক্ষ্য করে আসামে এনআরসি অভিযান চালিয়ে যেভাবে তারা সে রাজ্যে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে পাকাপাকি বিভাজন সেরে ফেলেছে, একই জিনিস যে এখানেও হবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?’
বামপন্থি নেতা সুজন চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘বিভিন্ন জনসভায় ইনশাল্লাহ বলে ভাষণ শুরু করা, মুসলিমদের জন্য আলাদা হাসপাতাল বা শুধু ইমামদের জন্য সরকারি ভাতা—এগুলো মমতা ব্যানার্জিই এ রাজ্যে চালু করেছেন।’
ভারতের যে কোনো রাজ্যের ভোটে সাধারণত বেশি গুরুত্ব পায় উন্নয়ন, চাকরি-বাকরি, গরীবি হটাও—এর মতো নানা প্রতিশ্রুতি এবং অবশ্যই ধর্ম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভোটে এবারে একটি ব্যতিক্রমী ইস্যু নিয়ে তুমুল চর্চা হয়েছে, আর সেটা হলো সংস্কৃতি।
ভারতের নানা হিন্দি-ভাষাভাষী অঞ্চলের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ‘জয় শ্রীরাম’ বলে সম্ভাষণ করাটা বাঙালিদের মানায় কি-না, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে তা নিয়েও।
অন্যান্য রাজ্যের অভিজ্ঞতা দেখলে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে এখানে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ আর আগের মতো থাকবে না
মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের গোবলয়ের দল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে একটি বিজাতীয় সংস্কৃতি আমদানি করতে চাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বাংলায় এখানকার নিজস্ব ভাষা-শিল্প-মননের সঙ্গে যার কোনো মিল নেই। এসব কথা তৃণমূল বলে আসছে অনেকদিন ধরেই।
বিজেপির জাতীয় স্তরের শীর্ষ নেতাদের তারা ‘বহিরাগত’ বলে আক্রমণ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত বাংলা বলার চেষ্টায় কীভাবে বিকৃত উচ্চারণে ‘সুনার বাংলা’ বলেছেন তা নিয়েও ব্যঙ্গবিদ্রূপ হয়েছে।
তৃণমূলের সিনিয়র এমপি কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, ‘মনে রাখতে হবে এই দলটা কলকাতার বুকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি পর্যন্ত ভেঙেছে।’
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক তার এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মাথাপিছু উপার্জন সারা দেশের জাতীয় গড়ের তুলনায় ক্রমশ কমেছে।’
জেএন