স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে দুই বেলা দুই মুঠো খেয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন গৃহবধূ নার্গিস বেগম (২৮)। বিয়ের ১৩ বছরে তাদের ঘর আলোকিত করে একে একে তিন সন্তান জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এরমধ্যে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের নাম উষা (১২), মেজো মেয়ের নাম ইতি (৭) ও একমাত্র অবুঝ ছোট ছেলে ইসরাইলের বয়স দেড় বছর। কিন্ত বিয়ের ১৩ বছরে এসে সেই সুখ আর সয়নি গৃহবধূ নার্গিসের কপালে। দুটি ছাগল মেরে ফেলার গুজবে তার স্বামী মোতালেবকে পিটিয়ে হত্যা করে কিছু মানুষরুপি অমানুষ। আর এর পরপরই তার ও ছেলেমেয়ের ভাগ্যে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এখন অবুঝ ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয় তাদের। কোনোদিন খেতে পান আবার কোনোদিন না খেয়েই পার করতে হয়। তাদের সাহায্যে তেমন কেউ এগিয়েও আসেনি। নিষ্পাপ ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ ও কান্না ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না তিনি। সামনে বর্ষাকাল আসলেও তাদের ঘরে ছাদ নেই। নেই কোনো স্যানিটেশন ব্যবস্থা।
যেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাতযাপন করেন সেই বাড়িটিও ছাদহীন। স্বামী মোতালেব বেঁচে থাকার সময় স্ত্রী নার্গিসকে কথা দিয়েছিল, বর্ষার আগে ঘরের ছাদ দিবেন। যাতে ছেলেমেয়ে নিয়ে পানিতে ভিজতে না হয়। কিন্ত কিছু অমানুষের প্রতিহিংসা ও গুজবের বলি হয়ে অকাল মৃত্যু হয় তার। ঘটনার ১৫/২০ দিন পর স্থানীয় এমপি ডা. মনসুর রহমান তার বাড়িতে গিয়ে বলে এসেছিলেন, তার ঘরের ছাদ দিয়ে দিবেন ও তাদের একটা কার্ড
করে দিবেন। সেটা বাস্তবে রুপ নেয়নি এখনো। ঘটনার পর পুঠিয়া থানায় ১৩ জনকে আসামী করে যে হত্যা মামলা দায়ের করা হয় সেই মামলায় এখন পর্যন্ত ৬ জন পুলিশের হাতে আটক হয়েছে। বাকি সাতজন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরমধ্যে সর্বশেষ যে আসামী আটক হয়েছে তার নাম ইয়াদুল। ইয়াদুলকে আদালতে পাঠিয়ে পুঠিয়া থানা পুলিশ ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে। শুনানি এখনো হয়নি বলে জানিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
সরজমিনে শনিবার দুপুরে পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়ায় অবস্থিত মৃত সোহরাবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার বাড়িতে ২ মেয়ে ও ১ ছেলে কান্নাকাটি করছে। সেই বাড়ির ঘরে ছাদ নেই। একটু বৃষ্টি হলেই ভিজতে হবে তাদের। নেই টয়লেট ব্যবস্থাও। সেই বাড়িতে তেমন ছেলে মানুষ নেই। ছোট বোনের স্বামী ছাড়া সবাই নারী। এ অবস্থায় তাদের কোনোভাবে সহায়তা করবে এমন কেউ নেই। গৃহবধূ নার্গিসের সাথে কথা হলে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, গত ১৩ বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল সোহরাবের সাথে। এরপর একে একে ৩ সন্তানের জন্ম হয়। স্বামীর বাড়ি না থাকার কারণে বাবার বাড়িতেই থাকতেন স্বামীসহ। ২০২০ সালের সেপ্টেমবর মাসের ১৬ তারিখ পুঠিয়া থেকে ঢাকায় ট্রাকে করে মাল নিয়ে যান। সেখান থেকে ১৭ তারিখে মাল নামিয়ে ১৮ তারিখ বাড়িতে ফেরত আসে। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে মাল নামাতে বাগমারার তাহেরপুর যান। ফেরার পথে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাসুপাড়ায় পৌঁছালে দুটি ছাগল ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে আহত হয়। ট্রাক না থামিয়ে টান দিয়ে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর পেছনে তাকিয়ে দেখেন পেছনে ১৫ থেকে ২০টি মোটরসাইকেল নিয়ে তাকে তাড়া করা হচ্ছে। যার ছাগল আহত হয় তার জামাই মোবাইল করে লোকজনকে জানায় ওই ট্রাক দুই মানুষকে মেরে পালিয়ে যাচ্ছে। এ খবর শোনার পর স্থানীয় লোকজন ব্যারিকেড দিয়ে ধরে তাকে আটকিয়ে
অমানুষিকভাবে পিটিয়ে আহত করে। এরপর তাকে বাসে উঠিয়ে দেয়। বাস থেকে তাকে পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়। এরপর দিন ময়নাতদন্ত শেষে তাকে দাফন করা হয়। থানায় একটি মামলা করা হয় ১৩ জনের নামে। ৫ জন আসামী আটক হলে স্থানীয় ইউপি সদস্যের মাধ্যমে তাকে আসামী প্রতি ২৫ হাজার টাকা করে দিয়ে মীমাংসার প্রস্তাব দেয় আসামি পক্ষ। পরে সব মিলিয়ে ৬ লাখ টাকার কথা বলা হলেও পরে তারা জানায়, আইনে যা হবে তাই মীমাংসার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত কয়জন আসামী আটক হয়ে তা তিনি জানেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি অসহায় ও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কোনো কোনো দিন তিনি সন্তানদের মুখে দুই বেলা দুই মুঠো খাবারও তুলে দিতে পারেন না। ঘরে ছাদ নেই। সামনে বৃষ্টি হলে ভিজতে হবে ছেলেমেয়ে নিয়ে। এর সবকিছুর জন্য দায়ী তার স্বামীর হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান তিনি। পলাতক আসামীদের গ্রেফতারের দাবিও জানান দ্রæত। যাতে কাউকে আর স্বামীহারা ও বাবা হারা না হতে হয়। তার ছেলেমেয়ের পড়াশোনা ও দুই বেলা দুই মুঠো ভাত তুলে দেয়ার জন্য তিনি সমাজের বিত্তশীলদের প্রতি আর্থিক সহায়তারও আবেদন জানান তিনি। এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুঠিয়া থানার ওসি তদন্ত আনোয়ার হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত ৬ জন আসামী আটক হয়েছে। এরমধ্যে সবশেষ গ্রেফতার হওয়া ইয়াদুলকে আদালতে পাঠিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। পলাতক আসামীদের দ্রæত গ্রেফতার করা হবে। কবে চার্জশিট হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সময় লাগবে। আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রটি নেই। ওই গৃহবধূকে ন্যায্য বিচার পাইয়ে দিতে পুলিশের পক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
এস/আর
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- [email protected], মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০