প্রভাষ আমিনঃ বিদেশ থেকে ফিরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করেন। এটা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। সাংবাদিকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের জন্য। আমার ধারণা সাধারণ মানুষও প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের জন্য অপেক্ষা করেন। কারণ সবগুলো টিভি চ্যানেল এ সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করে এবং এই সময়ে টেলিভিশনগুলোর টিআরপি বাড়ে।
সরকারের প্রধান নির্বাহীর জবাবদিহিতার এই নজির গণতন্ত্রের জন্যই ইতিবাচক। তবে সিনিয়র সাংবাদিকদের তোষামোদি প্রশ্নে এই ইতিবাচক ধারাটিই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এবার সিনিয়র সাংবাদিকদের আগে কর্মরত রিপোর্টাররা প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছেন। নাঈমুল ইসলাম খান প্রস্তাব দিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনে যেন রিপোর্টাররাই শুধু প্রশ্ন করে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী যেন সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন।
‘প্রধানমন্ত্রী যদি চালকদের সচেতনতা, বেপরোয়া চালানোর কথা বেশি করে বলে পরে সাধারণ মানুষের সচেতনতার কথা বলতেন; তাহলে ভালো হতো। উল্টোটা করার কারণে চালকদের মধ্যে একটা ভুল বার্তা যেতে পারে। আমার শঙ্কাটা এখানেই।’
অন্য সব সংবাদ সম্মেলনের মত এবারও সাংবাদিকবদের প্রশ্নের জবাবে অনেকগুলো ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সবগুলো নিয়ে এই পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। তবে সড়ক দুর্ঘটনা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আমার কিছু কথা আছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততার কোনো শেষ নেই। জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা বিষয় নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার ওপর আছে দল এবং জোটের রাজনীতি। এতকিছু সামাল দেয়ার পরও বিভিন্ন বিষয়ে তার যে খুটিনাটি পর্যবেক্ষণ, তা আমাকে বারবার মুগ্ধ করে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে কাজ শেষে ঘরের লাইট-ফ্যান বন্ধ করার পরামর্শও দেন প্রধানমন্ত্রী। শেভ করার সময় আমরা ট্যাপ চালিয়ে রাখি। পানির এই অপচয়টুকুও প্রধানমন্ত্রীর চোখ এড়ায় না। সড়ক দুর্ঘটনা এবং ট্রাফিক সচেতনতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে আমি বাস্তবতার নিরিখে একমত। অন্তত ১২ বছর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে গাড়ি চালানোর সুবাদে আমি জানি, সড়ক দুর্ঘটনার অনেকগুলো হয় সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে।
এটা ঠিক রাস্তায় পথচারীদেরই অগ্রাধিকার। তাদের ন্যূনতম কিছু নিয়মকানুন মেনে চলা উচিত। কিন্তু প্রায়শই আমরা সেইসব নিয়মকানুন মানি না। ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস থাকার পরও আমরা হুটহাট মাঝখান দিয়ে দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হই। রাস্তার যে অংশ দিয়ে মানুষ পারাপার করার কোনওই সুযোগ নেই, চালক যখন নিশ্চিন্তে গাড়ি চালিয়ে যান; তখনও হুট করে কাটাতারের বেড়া ঠেলে দৌড়ে আসা মানুষকে বাঁচাতে চালককে তখন অসম্ভব চেষ্টা করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী একদম ঠিক বলেছেন, দ্রুতগতিতে চলতে থাকা একটি গাড়ি হুট করে থামানো সহজ নয়। কখনো কখনো প্রায় অসম্ভব। আর মানুষ যখন ডানে বায়ে না তাকিয়ে হঠাৎ হাত উচিয়ে দৌড় দেন, তখন তাকে বাঁচাতে চালককে সুপারম্যান হতে হয়। ১২ বছরের গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অনেকবার ভাগ্যগুণে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি। অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা অবশ্যই আমার দোষ হতো না। আমি জানি আমার মত এমন অনেক চালক, অনিচ্ছায় দুর্ঘটনা ঘটান। অনেক ক্ষেত্রে চালক তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি থামিয়ে দিলে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সেই চালক তাৎক্ষণিক গণপিটুনি থেকে বাঁচার জন্য আরো জোরে গাড়ি চালিয়ে দেন। এই ছোট প্রবণতাটিও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি এড়ায়নি।
সাধারণ মানুষের আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বন্ধ হলে হয়তো চালকরা আরো মানবিক হতেন। একজন চালক যত মানবিকই হোন, গণপিটুনির ঝুঁকি তিনি নিতে চাইবেন না। দেখেশুনে রাস্তা পার হওয়া, নির্ধারিত স্থান দিয়ে রাস্তা পার হওয়া, আইন হাতে তুলে না নেয়া, গাড়িতে উঠলে হাত বা মাথা বাইরে না রাখা, ট্রাফিক আইন মেনে চলা- এসবই ভালো কথা, ন্যায্য কথা। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষ এত বেশি, সবার পক্ষে নিয়ম মেনে চলা সম্ভব হয় না।
বাসে উঠলে হাত-মাথা বাইরে না রাখার নিয়ম সবার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। কারণ অনেককে ঝুলে থাকতে হয়। তার তো পুরো শরীরই থাকে বাসের বাইরে। কিন্তু আমাদের মানুষের চাপ এত বেশি, সব মানুষ বাসের ভেতরে থাকবে, এটা কার্যকর করা সত্যি অসম্ভব। দেশের ১৬ কোটি মানুষ ট্রাফিক আইন মেনে চললে ভালো। কিন্তু সবাইকে আপনি বাধ্য করতে পারবেন না। কিন্তু চালকদের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে লাইসেন্স পেতে হয়। তাই দেশের সব মানুষকে ট্রাফিক আইন শেখানোর চেয়ে, চালকদের আরো সচেতন, আরো সতর্ক, আরো দক্ষ, আরো মানবিক করে তুলতে পারলেই রাস্তা অনেক নিরাপদ হবে।
প্রধানমন্ত্রী যা যা বলেছেন, তার প্রত্যেকটি কথা সত্য। কিন্তু তারপরও আমি জানি চালকরা আরো সতর্ক হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। অনেক দুর্ঘটনাই ঘটে বেপরোয়া গতি, খামখেয়ালিপনা, অদক্ষতা আর অদক্ষতার কারণে। চালকরা যদি সঠিব প্রক্রিয়া মেনে লাইসেন্স পেতেন, তাহলে তারা অবশ্যই আরো দক্ষ হতেন। কিন্তু শাজাহান খানের পরামর্শে গরু-ছাগল চিনলেই লাইসেন্স দেয়া হয় বলে তারা আর মানুষ চেনে না। লাইসেন্স থাকলে তবু কথা ছিল। কিন্তু গণপরিবহনের অনেক চালকেরই লাইসেন্স নেই, থাকলেও সেটা ভুয়া। অনেক চালক গাড়ি চালান, সহকারীকে দিয়ে।
এই জায়গায় আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। আইনের কঠোর প্রয়োগটাই আসল কথা। সেনানিবাসের ভেতরে কিন্তু আমাদের চালক বলেন, পথচারী বলেন; সবাই আইন মেনে চলেন। বাইরে বেরুলেই, আমরা সবাই রাজা। সিট বেল্ট না বাঁধার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমরা কয়জন সিট বেল্ট বেঁধে গাড়ি চালাই বা যাত্রী হিসেবে বেল্ট বাঁধি। দেশের বাইরে গেলে, এই আমরাই কিন্তু সিট বেল্ট প্রেমিক হয়ে যাই।
আমার সাংবাদিকতার গুরু মিনার মাহমুদ ১৮ বছর যুক্তরাষ্ট্রে দেশে ফেরার পর একদিন আমি তাকে লিফট দেই। গাড়িতে উঠেই তিনি নিজে সিট বেল্ট বাঁধেন এবং আমাকেও বাঁধতে বলেন। মিনার ভাই আমেরিকায় ট্যাক্সি চালাতেন। কিন্তু ঢাকার রাস্তার অবস্থা দেখে বললেন, আমি মনে হয় ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারবো না।
তিনি একটা গল্প বললেন। একবার তারা কয়েক বন্ধু নিউ ইয়র্কের বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় তাদের খুব তাড়া ছিল। নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারলে নিজ নিজ ক্যাবের পার্কিংয়ের জন্য মোটা অঙ্কের জরিমানা গুণতে হবে। বেশি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে পুলিশ তাদের আটকায়। সেই পুলিশ দয়ালু ছিলেন এবং নিউ ইয়র্কের ট্যাক্সিচালকদের অবস্থার কথা জানতেন। তাই তিনি তাদের সাবধান করে দিয়ে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ছেড়ে দিয়ে আবার তাদের আটকালেন এবং জরিমানা করলেন।
অপরাধ হলো, তাদের কারো সিট বেল্ট বাঁধা ছিল না। সেই পুলিশ বলেছিলেন, আমি তোমাদের জরিমানা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু তোমাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে দিতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তার প্রত্যেকটি কথা সত্যি। তিনি এও বলেছেন, তার কথা হয়তো অনেকের পছন্দ হবে না। সেই অনেকের দলে আমিও একজন। প্রতিটি সত্য কথা বলার পরও প্রধানমন্ত্রীর কথা আমার পছন্দ হয়নি, ভালো লাগেনি।
প্রধানমন্ত্রীর কথায় মমতার ঘাটতি ছিল। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, একটা ছেলের হাত চলে গেল বলে আপনারা কান্নাকাটি করেন। কিন্তু সে যে ট্রাফিক রুল মানলো না; সেটা বলেন না- তখন আমি কষ্ট পাই। রাজিব ট্রাফিক রুল মেনে চলতে পারলে ভালো হতো, সে যদি দোতলা বাসের দরজায় ঝুলে না থেকে পুরোপুরি ভেতরে থাকতো; খুব ভালো হতো। কিন্তু মরে যাওয়ার পর এতিম রাজিবের হাত ভেতরে ছিল না বাইরে; সে ট্রাফিক আইন মেনে ছিল না মানেনি; সেটা বিবেচনার সুযোগ নেই আসলে।
মানলাম রোজিনা কাছের ফুটওভার ব্রিজ রেখে রাস্তার মাঝখান দিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন রোজিনাকেই দায়ী করেন, আমরা কষ্ট পাই। অশিক্ষিত রোজিনাকে ট্রাফিক আইন জানতেই হবে, মানতেই হবে; এমন কোনো কথা নেই। মানতে পারলে ভালো। রাজিব বা রোজিনার মৃত্যুর পর তারা ট্রাফিক আইন মেনেছে কি মানেনি; সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বেশি করে পথচারী ও চালকদের সচেতনতামূলক প্রচারণার অনুরোধ করেছেন। এমনিতে গণমাধ্যম বছরজুড়েই সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নানা কিছু প্রচার করে। কিন্তু সমস্যা হলো চালকদের বেশিরভাগই তা দেখেন না।
প্রধানমন্ত্রী চালকদের সচেতনতার কথাও বলেছেন। তবে তার কথায় জনগণের সচেতনতাটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি চালকদের সচেতনতা, বেপরোয়া চালানোর কথা বেশি করে বলে পরে সাধারণ মানুষের সচেতনতার কথা বলতেন; তাহলে ভালো হতো। উল্টোটা করার কারণে চালকদের মধ্যে একটা ভুল বার্তা যেতে পারে। আমার শঙ্কাটা এখানেই।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- k24ghonta@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০