নজরুল ইসলাম জুলু : পুলিশ হলো একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা, যার দায়িত্ব নাগরিকদের এবং সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া, নাগরিকদের আইন মানায় বাধ্য রাখা, অপরাধ চিহ্নিত করে অপরাধীদের ধরা। সরকারি দলের বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর হয়ে কাজ না করে জনস্বার্থে কাজ করা। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। জনগণের বন্ধু হয়ে তাদের পাশে থাকা। কিন্তু, বাংলাদেশের পুলিশ কি জনগণের বন্ধু হতে পেরেছে? বিশেষত বিগত ১৬ বছরে বন্ধু না হয়ে বাংলাদেশের পুলিশ বরং নাগরিকদের কাছে নিপীড়ক হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে দমন-পীড়ন পুলিশকে ‘ভিলেন’ হিসাবেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপে বেপরোয়াভাবে সহযোগিতা করা নিজ দেশের মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করা, নরপশুর মতো নির্যাতন করা পুলিশ বাহিনী সাধারণ মানুষের চোখে 'বাংলাদেশ পুলিশ ' না হয়ে বরং হয়ে উঠেছিল 'পুলিশ লীগ'। সরকার কে টিকিয়ে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সাথে তাল মিলিয়ে পুলিশ বাহিনীও যোগ দেয় বিরোধী মত কে দমনের খেলায়। সরকারের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হওয়ায় জনগণ ও বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব। পুলিশের দীর্ঘদিনের নির্যাতনে জনগণের মনে পুলিশ বাহিনীর প্রতি অসন্তোষ দানা বাঁধে। যে পুলিশের জনগণের বন্ধু হয়ে থাকার কথা, তারা জনগণের শত্রু হয়ে উঠল কেন?। এর অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই দায়ী করছেন 'প্রবিধান'কে। প্রবিধান অনুযায়ী বলতে গেলে পুলিশ কখনোই জনগণের নয়, পুলিশ সব সময়ই সরকারের। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত কিংবা ছাত্র- কে ক্ষমতায় এল, সেটা দেখার সুযোগ পুলিশের নেই। যেই ক্ষমতায় থাকুক, পুলিশ তার অর্ডার মানতে বাধ্য হয়। এমন দূর্বল প্রবিধানের কারণেই স্বৈরাচার হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনী কে নিজেদের 'পেটোয়া বাহিনীতে' রূপান্তর করেছিল। পেটোয়া বাহিনীতে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় বিগত ১৬ বছরে পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পদন্নোতির ক্ষেত্রে প্রার্থীর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয় সংক্রান্ত বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। ফলপ্রসূতে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে দলীয়করণ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। ঠিক এই কারণেই পুলিশ বাহিনী বিগত ১৬ বছরে জনগণের সেবকের জায়গাটি হারিয়ে 'পুলিশ লীগের' তকমা পেয়েছে। শুধু এবারই নয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশকে সরকারের ‘লাঠিয়াল’ হিসাবে ব্যবহারের নজির দেখা গেছে সব সরকার আমলেই। তবে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার সকল মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছিল। যোগ্য, সৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না দিয়ে অযোগ্য ও হাসিনা সরকারের হুকুমের গোলামদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী।
জুলাইয়ে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ বাহিনী ওরফে পেটোয়া বাহিনী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের হুকুমের তালিম করার সকল মাত্রা অতিক্রম করেছিল। আন্দোলন দমাতে প্রাণনাশক ভারী অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের বেপরোয়া ভাবে গুলি করা, লাশ গুম করা ও পুড়িয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজও পুলিশ কে করতে দেখা গেছে।
আন্দোলনের দিন যতই বাড়ছিল ততই পুলিশ বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতনের স্থির চিত্র ও ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, পুলিশ বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ, ঘৃণার জন্ম হয়। ৫ই আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানের পর যখন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালায় তখন পুলিশ বাহিনীর প্রতি জনগণের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নজিরবিহীন জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ বাহিনী। ব্যাপক জনরোষের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যায় পুলিশ বাহিনী। আত্মগোপনে চলে যাওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৮০০ পুলিশ সদস্য এখনও কাজে যোগদান করেননি বলে জানা গেছে। কয়েক দফায় তাদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হলেও কোনো হদিস নেই এসব সদস্যের। তারা কোথায় আছেন, সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই পুলিশ সদর দপ্তরের কাছে। ফলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেকটা বিপর্যয়ের মধ্যে দেশের পুলিশি ব্যবস্থা। এক মাস পার হলেও পুলিশি ব্যবস্থাকে এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয় নি।
এইদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে প্রথম থেকেই বিতর্কিত ভূমিকায় ছিলেন পুলিশের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা। তাদের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান অত্যন্ত সুস্পষ্ট ছিল। ফলপ্রসূতে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানের পর আন্দোলনকারীদের হয়রানি, সমন্বয়কদের হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনসহ নির্বিচারে গুলি করে শতশত ছাত্র-জনতা হত্যা ও আহত করা, লাশ গুম ও পোড়ানোর নির্দেশদাতা বিতর্কিত এসব কর্মকর্তা এখন লাপাত্তা। তাদের অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। খোদ পুলিশের মধ্যেই আছে নানা আলোচনা। কেউ বলছেন, তারা একটি বিশেষ বাহিনীর হেফাজতে আছেন। কারও দাবি, তারা প্রশাসনের সহায়তায় দেশ ছেড়েছেন।
এদের মধ্যে কেউ আবার গণপিটুনি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন-এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। পলাতক এসব কর্মকর্তার মধ্যে আছেন সাবেক এসবি প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ঢাকা জেলার সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম প্রমুখ। প্রকৃত পক্ষে তারা কোথায় আছেন, কেন আইনের আওতায় আসছেন না, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। এসব কর্মকর্তাসহ পুলিশের শীর্ষ অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও হয়েছে।
এখন পর্যন্ত তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য শীর্ষ কর্তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি জানা যায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে পালিয়েছেন। পাটগ্রাম থানা পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, দহগ্রাম ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া ওলেরপাড়ার এলাকার পাচারকারী শুভ পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমারের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বিশেষ সূত্রে জানা জায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অত্যন্ত বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিবি হারুন ৭-৮ আগষ্ট পুলিশের সিভিল ড্রেস পরিধানকারী কিছু সদস্যদের হাতে গণ ধোলাই খাওয়ার পর গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি হন। এখন তিনি কোথায় কী অবস্থায় আছেন কিছুই জানা যায় নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে ৩৮টি হত্যা মামলা ও সদ্য বিদায়ী আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু এত মামলা হওয়ার পরও কেন এই সমস্ত অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না তা নিয়ে জনমনে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যাদের নির্দেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরও কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না তা নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
এইদিকে, স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশের যেসমস্ত ওসি দের নির্দেশনায় হাজার হাজার ছাত্র জনতার উপর গুলি করা হয়েছে তারা এখনো ওসি হিসেবে বিভিন্ন থানায় বহালতবিয়তে রয়েছেন। এতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহ সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের যে দূরুত্ব তৈরি হয়েছে তা কমানো সম্ভব হবে না। অভিযোগ উঠেছে কিছু ওএসডি পুলিশ কর্মকর্তা ও বর্তমানে রিটায়ার্ড পুলিশ কর্মকর্তা মিলে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এই সিন্ডিকেট টাকার লেনদেনের মাধ্যমে আওয়ামী আমলে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারাও বিভিন্ন জায়গায় ট্রান্সফার ও প্রমোশন পাচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের ২লক্ষ ৩০ হাজার সদস্যদের মধ্যে প্রায় ১লক্ষ ৪০ হাজার পুলিশ স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৫ই আগষ্টের গণ অভ্যূত্থানের পর জনরোষের মুখে পড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ পুলিশ সদস্য থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে যায়। এদের অনেকেই এখনো কর্মস্থলে যোগদান করেননি ।
ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়াও সারা দেশের থানা গুলোতে প্রায় ৭০০জন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রয়েছেন লোকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে। আওয়ামী শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া এসমস্ত ওসি গুলোর নেতৃত্বেই বিভিন্ন থানার পুলিশ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর জুলুম করেছিল। সারা দেশে গুটি কয়েকটি জায়গায় কয়েকজন ওসি কে বদলি করা হলেও বেশিরভাগ ওসি তাদের পূর্বের জায়গায় বহালতবিয়তে রয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন এখনো পুলিশের পদায়ন, বদলি বা পদন্নোতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা রিপোর্ট, যোগ্য এবং ১৬ বছর ধরে বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সুযোগ না দিয়েই ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োগকৃত পুলিশ কর্মকর্তাদেরই বিভিন্ন জায়গায় বদলি পদায়ন ও পদোন্নতি করা হচ্ছ। ফ্যাসিবাদের দোসরদের মূলোৎপাটন না করে তাদের পুনর্বাসন করলে দ্বিতীয় স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন ব্যহত হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশি কার্যক্রমকে পুরোপুরি চালু করার কার্যক্রমের চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর বেশি ব্যস্ত পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে। এখন পর্যন্ত যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তাতে অনেক পেশাদার কর্মকর্তা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন; এর মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তাও রয়েছেন। পুলিশের বদলি-পদোন্নতির তালিকায় কেবল ‘বঞ্চিতরাই’ আসছেন না; ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এবং নানা তদবিরেও নাম ঢুকছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে। সুত্র মতে জানা যায়, পুলিশ সদর দপ্তর ও সাতটি রেঞ্জে যাঁদের ডিআইজি হিসেবে পদায়ন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন। গত সরকারের সময়ে পুলিশের ভালো পদগুলোতে তারা কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত ৯০৭ জন পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি হয়েছে। ইতোমধ্যেই তাদের পদোন্নতিজনিত পদে পদায়নও করা হয়েছে। এদের মধ্যে পুলিশ সুপার (এসপি) থেকে অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা ১১১ জন। আছেন অতিরিক্ত আইজি (গ্রেড-১) একজন, ডিআইজি ৮০ এবং এসপি ৩০ জন। ৬৪ জেলার মধ্যে ইতোমধ্যেই ৫০টি জেলায় নতুন এসপির পদায়ন করা হয়েছে। সব মেট্রোপলিটন পুলিশে দেওয়া হয়েছে নতুন কমিশনার। একইভাবে সব রেঞ্জ অফিসে পদায়ন করা হয়েছে নতুন ডিআইজি। শুধু তাই নয়, কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ৭৫৩ জন পুলিশ সদস্যকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে গত এক মাসে। এদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে নায়েক হয়েছেন ৬৭৭ জন। এছাড়া কনস্টেবল থেকে এটিএসআই পদে ১২ জন, কনস্টেবল/নায়েক থেকে এএসআই ৩১ জন, এএসআই থেকে এসআই ১৮ জন নায়েক থেকে এএসআই (সশস্ত্র) ও এএসআই (সশস্ত্র থেকে এসআই (সশস্ত্র) পদে ১৫ জন এবং এটিএসআই থেকে টিএসআই পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ছয় জন।গত এক মাসে পুলিশ পরিদর্শক হিসাবে ৪৩ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। এদের মধ্যে এসআই (নিরস্ত্র) থেকে পরিদর্শক (নিরস্ত্র) পদে ১৬ জন, এসআই (সশস্ত্র) থেকে পরিদর্শক (সশস্ত্র) পদে ২৬ জন এবং সার্জেন্ট থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন একজন।
এছাড়া সারা দেশে পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার ৮৩২ জন কর্মকর্তার পদায়ন হয়েছে। এদের মধ্য থেকেই দেশের বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে থানার সংখ্যা ৬৬৪টি। এর মধ্যে বিভিন্ন রেঞ্জের অধীন ২২৯টি এবং মেট্রোপলিটনের অধীনে রয়েছে ১১০টি থানা। বাকি থানাগুলো হলো হাইওয়ে ও নৌ পুলিশের। সব মিলিয়ে পুলিশের অপারেশনাল থানা হলো ৬৩৯টি। প্রায় অধিকাংশ থানা গুলোতই এখনো সঠিকভাবে কার্যক্রম শুরু সম্ভব হয় নি।ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক রাজনীতিকরণ এবং দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য অভিযুক্ত হয়েছে পুলিশ বাহিনী। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর থানায় হামলা, ভাঙচুর, হত্যাসহ নানা কারণে দেশজুড়ে পুলিশের প্রায় সব কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভেঙে যায় সদস্যদের মনোবল, স্থবির হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী।
এ কারণে আন্দোলনকারীসহ বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশে সংস্কারের জোরালো দাবি ওঠে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশের ভাবমূর্তি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ছে না। দৃশ্যত পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী ঘরানার পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে ও স্থানে পদায়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তারা। পদায়ন পদোন্নতি ও বদলির আড়ালে ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় যেসমস্ত পুলিশ কর্মকর্তারা পেটোয়া বাহিনীতে পুলিশ বাহিনীকে রূপান্তর করতে সাহায্য করছে তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার ও যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অনেকেই হতাশা প্রকাশ করছেন।
পুলিশের সংস্কারের ওপর জোর না দিয়ে পদোন্নতি ও পদায়নের ‘প্রতিযোগিতায়’ মেতে উঠায় সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। পুলিশ সদর দপ্তর এবং সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জানা যায় পুলিশ প্রশাসনকে আওয়ামী দোসরমুক্ত করে বৈষম্যমুক্ত একটি যুগোপযোগী আধুনিক বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলা হবে। সে লক্ষ্যেই কার্যক্রম চলমান। কিন্তু একটি চক্র কৌশলে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এ প্রক্রিয়ায়। তারা জড়িয়ে পড়ছে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি বাণিজ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে। এ কারণে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে গত বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারে ৬ টি কমিশন গঠনের ঘোষণা করেন। এতে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সফর রাজ হোসেনকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় পুলিশের কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক বল প্রয়োগের কারণে সাধারণ মানুষের সাথে পুলিশের যে বিরূপ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সে কারণে সংকট রয়ে গেছে। এটা দূর করা না গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও অনেক সময় লাগবে। এর জন্য প্রয়োজন পুলিশের যৌক্তিক ও সময়োপযোগী সংস্কার এবং পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবক হিসেবে পুনরায় গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি দলীয় বা রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে। স্বৈরাচার সরকারের যারা তাবেদারি করেছে সেসকল পুলিশ কর্মকর্তাদের যেন আইনের আওতায় আনার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। আওয়ামী ঘরানার পুলিশ কর্মকর্তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে জনমনে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে এবং তৈরি হবে হতাশা।
পুলিশ বাহিনীর প্রকৃত সংস্কার নিয়ে সাধারণ মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছে পূরণ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে পুলিশ বাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমবে না।
বিএ...
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- k24ghonta@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০