ইমরান আলী: রাজশাহী শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মতিহার থানা। থানা থেকে কিলো দুয়েক থেকে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা শুরু। পদ্মার এপারে রাজশাহী ওপারে ভারত। নদীর মাঝখানের দূরত্বও বেশি নয়। পদ্মায় ভাগ করে দেওয়া এপারের এলাকা বাঘা, চারঘাট, রাজশাহী শহর, পবা এবং গোদাগাড়ী। সারা দেশে ফেন্সিডিলের প্রবেশের যে সকল রুট রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই এলাকা। তবে বাংলাদেশে হেরোইন প্রবেশের অন্যতম বড় যে রুট হিসেবে বিবেচিত সেটি হলো গোদাগাড়ী। এ সীমান্ত এলাকা দিয়ে একদিকে যেমন ফেন্সিডিল আসে তেমনি আসে হেরোইনও।
মতিহার থানা সীমান্ত এলাকার মিজানের মোড়। দিনের পুরো সময়ই মাদকসেবী আর মাদক ব্যবসায়ীর আনাগোনা থাকলেও রাত ৮টার পর থেকে এটি যেন বেড়ে যায়। মাদক ব্যবসায়ী আর মাদকসেবীরা মূলত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কোনো রাখঢাক না রেখেই একেবারে প্রকাশ্যেই চলে মাদকের কারবার। থানা পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ভয়ডর নাই।
সরেজিমন অনুসন্ধানের জন্য যাওয়া হয় মিজানের মোড় এলাকায়। মোটরসাইকেল নিয়ে এলাকায় প্রবেশের আগেই লোকজনের তাকানোর দৃশ্যটা মোটেই ভালো লাগল না। আলো-অন্ধকারের রাস্তার পাশের টং দোকানে টিভি চলছিল। আইপিএলের খেলা দেখার জন্য ভিড় ছিল। মোটরসাইকেল দাঁড়াতে লোকজনের আনাগোনাটাও যেন আমাদেরকেই ঘিরে। কোনো পরিচয় জানার আগেই বলল ‘ভাই কয় পিস’। সেই সময় বুঝতে বাকি থাকল না সঠিক জায়গাতেই আমরা এসেছি। কয় পিসের জিজ্ঞাসা করতেই উল্টো জিজ্ঞাসা ‘কী কয় পিস’। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন যা চান, দুটোই আছে। তার মানে ফেন্সিডিলও আছে, আছে ইয়াবাও। তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে অনেকটা নিজের লোক করে নেয়। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন করলে সে তথ্য দেওয়া শুরু করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিজানের মোড় এলাকায় ফেন্সিডিলের প্রভাবটাই অনেক বেশি। অচেনা লোক দেখলেই তারা মনে করে কাস্টমার। খাবারের জন্য হোক আর ব্যবসায়ের জন্য হোক এটি তাদের কাছে কোনো ব্যাপার না। নতুন লোক গেলে যেন প্রতিযোগিতায় নামেন তারা।
শুধু কি মিজানের মোড়? এই থানা এলাকার ডাঁশমারী, জাহাজাঘাটের মোড়, কাশেমহাজির মোড়, নাদেরের মোড়- এ সবই একেবারে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা। প্রতিদিনই নদীর ওপার থেকে হাজার হাজার বোতল ফেন্সিডিল এপারে আসে।
শহরের দক্ষিণপ্রান্তের পদ্মাপাড় ঘেঁষা পুরো এলাকাজুড়েই ফেন্সিডিলের দৌরাত্ম্য এছাড়াও জেলার চারঘাট থানার মুক্তারপুর, ইউসুফপুর, বাঘার মীরগঞ্জ, আলাইপুর, নাড়িয়ারচর, গোদাগাড়ির সুলতানগঞ্জ, মহিষালবাড়ি, ডাইংপাড়া। অভিযোগ রয়েছে, চারঘাট পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সহযোগিতায় সেখানে মাদকের ব্যাপক কারবার চলে।
শুধু সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা নয়। শহরের ভেতরেও রয়েছে অন্তত শতাধিক স্পট। নগরীর টিকাপাড়া, খুলিপাড়া, মোন্নাফের মোড়, তালাইমারি, লক্ষ্মীপুর, বর্ণালীর মোড়, উপশহর, গুড়িপাড়া, ভেড়িপাড়াসহ নগরজুড়ে শতাধিক স্পটে মাদকের কারবার অনেকটাই প্রকাশ্য।
গোটা দেশের মধ্যে সুন্দর শহর হিসেবে রাজশাহীর খ্যাতি রয়েছে। এখানকার বড় বড় রাস্তা আর রাস্তার ধারে ফুলের বাগান যে কাউকে মুগ্ধ করে তুলবে। পাশের পদ্মাপাড়ের শীতল হাওয়ায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। অথচ এ সুন্দর শহরটিকে গ্রাস করছে মাদক। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় মাদকে এখন ভরপুর। শুধু মাদককে ঘিরে এখানকার কিছু অসাধু পুলিশ যুগের পর যুগ রাজশাহীতে আছেন। আর এটাকে পুঁজি করে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটই মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া করে তুলেছে। বিনিময়ে এই পুলিশ সদস্যরা কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরে কিছু অসাধু এসআই রয়েছেন যারা দীর্ঘ ১০/১২ বছর রাজশাহীতে থেকেই মাদকের এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের মধ্যে এসআই আব্দুল মতিন, এসআই গোলাম মোস্তফা, এসআই উত্তম কুমার রায়, এসআই সেলিম রেজা, এসআই তবারক হোসেন, এসআই আব্দুর রশিদ, এসআই শফিকুল ইসলাম, এসআই শরিফুল ইসলাম, এসআই মাহবুব হোসেন, এএসআই ইউসুফ হোসেন, এএসআই কামরুজ্জামান, টিএসআই হানিফ, টিএসআই মনিরুল অন্যতম।
বছরের পর বছর জুড়ে আরএমপিতে থাকার সুবাদে এরা সবকিছুই চেনে জানে। এ কারণে তারা মাদকের বিশাল এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে এসআই আব্দুল মতিন বলেন, আমরা কোনোভাবেই মাদকের বিষয়ে জড়িত নয়। এগুলো মনগড়া তথ্য।
এদিকে আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক যোগদান করার পর থেকেই মাদকের বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ হলেও কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে বার বার বক্তব্য দিয়েছেন।
ভারতের সীমান্ত লাগোয়া জেলা রাজশাহী হওয়ায় পদ্মা নদী পেরিয়ে খুব সহজে আসছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা আর ফেন্সিডিল। এসব খুচরো পাইকারী দুভাবেই বিক্রি হচ্ছে। নগরী ও উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত মাদকের এ নেটওয়ার্ক। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পবা মেট্রোপলিটন পুলিশের থানাসমূহ বিশেষ করে কাঁশিয়াডাঙ্গা রাজপাড়া বোয়ালিয়া মতিহার চন্দ্রিমা থানা এলাকা চারঘাট বাঘাজুড়েই মাদকের রমরমা ব্যবসা।
নগরীর গুড়িপাড়া মাদকের ড্যাণ্ডি নামে খ্যাত। অন্যদিকে গোদাগাড়ী থানা মাদক সম্রাটদের স্বর্গরাজ্য। চারঘাট বাঘার সীমান্ত এলাকাতে মাদকের ব্যবসা জমজমাট। ভারত থেকে খুব সহজে সীমান্ত গলিয়ে চলে আসছে মাদকের চালান। বাংলাদেশের জন্য ভারতের মালদা মুর্শিদাবাদ সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে অনেক ফেন্সিডিল তৈরির কারখানা। নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ রয়েছে ফেন্সিডিল, হেরোইন, গাঁজা ও মদের। আর ফেন্সিডিল ও ইয়াবা শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের অলিগলিগুলো নেশাখোরদের আড্ডায় পরিণত হয়।
এ বিষয়ে আরএমপির মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, কারো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এক স্থানে বেশি সময় থাকলে বিভাগীয় কোনো সমস্যা নেই। তবে অপরাধ করলে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজশাহী জেলায় সদ্য যোগদানকৃত পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন বলেন, মাদকের বিষয়ে কোনো ছাড় নয়। সে পুলিশ হোক আর মাদক ব্যবসায়ী হোক।
তিনি বলেন, নতুন করে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা হচ্ছে। তালিকা হাতে আসলে অভিযান পরিচালনা করা হবে। সূত্র: বাংলাদেশর খবর
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- [email protected], মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০