নাটোর প্রতিনিধিঃ নাটোর সদর উপজেলার তেলকুপি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিচালনা পর্ষদ সভাপতির খপ্পরে পরে বিভ্রান্ত দিনাতিপাত করছেন ১০ম শ্রেণীর এক ছাত্রী। অবিবাহিত সভাপতি ওই ছাত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিয়েতে রাজী করাতে বাবা-মাকেও চাপে রেখেছেন ওই সভাপতি জালাল উদ্দিন। এলাকার ক্যাডার হিসেবে পরিচিতি আর যুবলীগের একজন কর্মী হওয়ায় ভীত হয়েই রাজি হয়েছেন বাবা-মা। মেয়েটি পরেছেন বেকায়দায়। এদিকে মেয়েটিকে পৃথক ভাবে পড়াতে শিক্ষকদের চাপে রেখেছেন সভাপতি। বাধ্যহয়ে স্বাভাবিক ক্লাসের পাশাপাশি ওই ছাত্রীকে পৃথক ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। মেয়েটির পৃথক ক্লাস নেওয়ার জন্য শিক্ষকদের রুম সরিয়ে তা একটি ভাঙ্গা ঘরে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ৬১ হাজার টাকার চেক দিতে প্রধান শিক্ষককে বাধ্য করা, বিদ্যালয়ের নতুন টিন সেট করার নামে দীর্ঘদিন আঙ্গিনার টিন খুলে রাখা, বিদ্যালয়ের বেশি জমি দিয়ে কম জমির এওয়াজ বদল করা ও প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে স্যান্ডেল দিয়ে মারপিট করতে উদ্যত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। বিষয়গুলো জানাজানি হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন শুরু করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তেলকুপি উচ্চ বিদ্যালয়ে পর পর তৃতীয় বারের মত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন পার্শ্ববর্তি মদনহাট গ্রামের ফজলু মন্ডলের ছেলে জালাল উদ্দিন মন্ডল। জালাল ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। ২৪ বছর বয়সী ওই যুবক অত্যন্ত ধূর্ততা আর ক্ষমতার ব্যবহার করে তৃতীয় বারের মত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেনকেও রেখেছেন বিভিন্ন চাপে।
বিধিমোতাবেক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব মো: মোয়াজ্জেম হোসেন মিঠু মোল্লা।
নাটোর জেলা আওয়ামীলীগ এর একজন বড় নেতার ছত্র ছায়ায় লালিত পালিত এই জালাল বিদ্যুতসাহী পদ প্রাপ্ত হন। তার হিংস্র আচরণে মিঠু মোল্লা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সুযোগে অন্য সদস্যদেরকে ভয় দেখিয়ে প্রথমবারের মত সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
২০১৭ সালেও বিধি মোতাবেক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন জনাব মোঃ আলতাব হোসেন।কিন্তু কমিটির মেয়াদ ১০ মাস পার হতেই জালাল এর হুমকিতে তিনিও পদত্যাগ করতে বাধ্যহন এবং পূর্বের কৌশলে সদস্যদেরকে হুমকি প্রদর্শন করে জালাল পুনরায় সভাপতি নিযুক্ত হন।
বিদ্যালয়ের পার্শ্বেই কৃষিবিদ নার্সারির প্রোপাইটার মো: শাহিনুর রহমান তোতার নার্সারী।
তোতার সাথে আলোচনা সাপেক্ষে তাকে ২৫ কাঠা জমি দিয়ে স্কুলের নামে মাত্র ২০ কাঠা জমি নিয়ে এওয়াজ বদল করেছেন। কথিত আছে, এর মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সভাপতি জালাল।
সভাপতি জালাল উদ্দিন মন্ডল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শিক্ষক কর্মচারীদের শোকজ -সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের তটস্থ করে রাখেন। তার কথা না শোনায় গত মার্চ মাসে তিনি বিদ্যালয়ের ক্লাস চলাকালীন অবস্থায় প্রকাশ্যে প্রধান শিক্ষককে স্যান্ডেল দিয়ে পেটাতে উদ্যত হন। এরপর বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে মোট চারটি চেকে তিনি ৬১হাজার টাকা ব্যাংক থেকে তুলেছেন। অথচ ওই টাকার বিপরীতে তিনি কোন রেজুলেশন পাশ করাননি।
নাটোর সদর উপজেলা পরিষদ থেকে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনার পুরাতন টিন পরিবর্তন জরুরী কারণ দেখিয়ে ০৫ বান্ডিল টিন অনুদান হিসাবে গ্রহন করেছে সভাপতি। এরপর নিজ পিতাকে দিয়ে পুরাতন টিনগুলো খুলেছেন। কিন্তু আজও তিনি নতুন টিন সেট করাননি। উপরন্তু টিনগুলো সেট করতে বিদ্যালয়ের গাছ বিক্রি করা লাগবে বিধায় প্রধান শিক্ষককে বিভিন্ন অফিসে পাঠিয়ে গাছ কাটার অনুমতি নিতে চাপে রেখেছেন প্রধান শিক্ষককে। অনুমতি নিয়ে গাছ কেটে টিন সেট করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অথচ পুরাতন টিনের স্থলে নতুন টিন সেট করতে কোন গাছ কাটার প্রয়োজন নেই। এই সুযোগে তিনি বেশ কয়েকটি মেহগিনি গাছ কেটে বিক্রি করে পকেটে টাকা তুলবেন বলে ধারণা করছেন সচেতন মহল। গত ৭ মাস আগে পুরাতন টিনগুলো খুলে রাখায় সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে অসহনীয় সমস্যায় পড়ছে শিক্ষার্থীরা। প্রতিনিয়ত তাদের কাদা ভেঙ্গে ক্লাস করতে হচ্ছে বলে দাবী করেছে শিক্ষার্থীরা।
গত স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে বিকেল ৩ টায় বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিদ্যালয় কতৃপক্ষ। অথচ রাতে বিদ্যালয় চত্বরের একই জায়গায় নাটক পরিবেশনের নামে গভীর রাত পর্যন্ত কাশেম মালার প্রেম নামে অশ্লীল যাত্রাপালার আয়োজন করে সভাপতি জালাল।
গত ১লা বৈশাখ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পান্তা ভাত-ইলিশ খাওয়ানোর কথা বলে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছে থেকে ২০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে সভাপতি। ওই দিন পঁচা চালের পান্তা ভাত করা হয়। অথচ কোন ইলিশ মাছের আয়োজন করা হয়নি। পচা গন্ধযুক্ত পান্তা ভাত শিক্ষার্থীরা না খেতে পেরে দু:খ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। অনেকে সামান্য পান্তা খেলেও বাড়িতে যেয়ে অসুস্থ হয়ে যায়। বেঁচে যাওয়া পান্তা ভাত বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তি এক কৃষককে দিয়ে দেওয়া হয়। পান্তাগুলো গরুকে খাওয়ানোর পরই গরুটি ছটফট করতে করতে মারা যায়।
বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী মিষ্টি খাতুন। শ্রেণী রোল ০৮। মিষ্টির বাড়ি নলডাঙ্গা থানার সেনভাগ টুলটুলি পাড়া গ্রামে। তার বাবা একজন দরীদ্র দিন মজুর। মাঝে মাঝে ভ্যান চালায় আবার অন্যের জমিতে দিন মজুর হিসেবেও কাজ করেন। সম্প্রতি মিষ্টিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে সভাপতি জালাল উদ্দিন মন্ডল। জালালের কথায় ভয়ে মেয়েকে বিয়েতে রাজী হতে চাপে রেখেছেন তারা। কিন্তু মিষ্টি এই বিয়েতে রাজি নয়। সম্প্রতি মেয়েটি তার নিজের এক হাতে লোহার দন্ড দিয়ে আগুনের ছ্যাকা দিয়েছে। বিভিন্ন জনের কাছে সে জানিয়েছে, জালালের সাথে তার বিয়ে দিলে সে আত্মহত্যা করবে।
মিষ্টির বাবা-মাকে বিয়েতে রাজি করিয়ে সে শিক্ষকদের ওপর শুরু করে নির্যাতন।
প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে সভাপতি জালাল অন্য শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে প্রতিদিন তিনজন করে শিক্ষক মিষ্টির বাড়িতে গিয়ে তাকে পড়ায়। এতে শিক্ষক মন্ডলী রাজি না হওয়ায় তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্টাফ অফিস তাৎক্ষনিক ভাবে সরিয়ে বিদ্যালয়ের প্রবেশ পথের একটি ভাঙ্গা- পরিত্যাক্ত কক্ষে তা স্থানান্তর করে। বর্তমানে শিক্ষক স্টাফ রুমে শিক্ষকরা বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে পৃথকভাবে পড়াচ্ছেন। মেয়েটিকে নিয়মিত না পড়ালে শিক্ষকদের পা ভেঙ্গে দিবে জানিয়েছেন সভাপতি জালাল।
সভাপতি জালাল উদ্দিন মন্ডল প্রতিদিন সকালে লুঙ্গি পরে স্কুলে প্রবেশ করে। সারাদিন বসে থাকে। শিক্ষকরা ক্লাসে গেলে প্রতিরুমে গিয়ে ৫-৭ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। এসময় শিক্ষার্থীরা বিব্রত হলেও তিনি তার কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। নির্ধারিত দিনে সেশনাদী আদায় হওয়ার পর ব্যাংকে জমা হলে তিনি প্রধান শিক্ষকের সইসহ চেক নেন। এপর্যন্ত চারটি চেকে তিনি নিয়েছেন ৬১ হাজার টাকা। অথচ এর কোন রেজুলেশন করেননি সভাপতি জালাল।
সম্প্রতি সভাপতি জালাল বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষ রদ-বদল করেছেন। মাঝে মাঝেই ছোট-খাট বিষয় নিয়ে উত্তেজিত হয়ে দপ্তরীকে ঘন্টা দিতে বাধ্য করান। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত ১২ মে তিনি দশম শ্রেণীতে প্রবেশ করে ক্ষোভ প্রকাশ করা শিক্ষার্থীদের হুমকি প্রদান করেন। এর পর থেকে গত ২ দিন বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে চলেছে। সোমবারে ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩ জন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সভাপতি জালাল উদ্দিন জানান, তিনি লুঙ্গি পড়ে বিদ্যালয়ে যান এটা সত্য। তবে অন্য অভিযোগ গুলো মিথ্যা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবী করেন, মিষ্টির সাথে তার বিয়ের কথা হয়েছিল। তবে সাবালিকা হলেই তার পদক্ষেপ নেয়া হবে।
তবে এব্যাপারে মিষ্টির বাবা মিষ্টির সাথে জালালের বিয়ের প্রস্তাবটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সর্বশেষ সোমবার দুপুরে সভাপতি জালাল বিদ্যালয়ে গিয়ে দপ্তরীকে ঘন্টা বাজিয়ে বিদ্যালয় ছুটি দিতে নির্দেশ দেন। এসময় তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের চলে যেতে বলেন। আর প্রধান শিক্ষককে আরও একটি চেক সই করতে বলেন।
বিষয়টি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন সভাপতির বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমজান আলী আকন্দ জানান, সোমবার অকস্মাৎ বিদ্যালয় ছুটি দেওয়ার খবরে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। এসময় সকল অভিযোগ তিনি শুনেছেন। পরবর্তিতে সভাপতি আর প্রধান শিক্ষককে জেলা শিক্ষা অফিসে ডেকে যার যার দায়িত্ব পালন করতে সতর্ক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এর ব্যাত্যয় ঘটলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও দাবী করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন জানান, বিষয়টি তিনি জানেন না। এব্যাপারে বিদ্যালয় কর্তপক্ষের অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক আর সচেতন মহলের দাবী, সভাপতি জালাল একজন অর্থলোভী, অসামাজিক, নিরক্ষর, দাঙ্গাবাজ, ক্যাডার প্রকৃতির মানুষ। অবিবাহিত হওয়ায় মেয়ে শিক্ষার্থীরাও তার কাছে শঙ্কার কারণ। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পড়ালেখা বজায় রাখা আর শিক্ষার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তার অপসারণ জরুরী। এব্যাপারে প্রশাসন ও সরকারের সহযোগীতা আর পদক্ষেপ কামনা করেছেন সকলেই।
খবর২৪ঘণ্টা.কম/নজ
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- [email protected], মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০