বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিক কারণে মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়ার গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজ নামে পরিচিত মাদক চোরাচালানের তিনটি প্রধান অঞ্চলের কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরাও বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে সহজে ব্যবহার করতে পারছেন। মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সীমান্ত থাকায় বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বেড়েছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের চোরাচালান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন চার ধরনের মাদকসহ
বাংলাদেশে ২৭ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। এগুলো হলো- ম্যাজিক মাশরুম, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন (ডিএমটি), লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (এলএসডি), ক্রিস্টাল মেথ বা আইস বা মেথামফিটামিন, এস্কাফ সিরাপ, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন,কোকেন প্যাথিডিন, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন (টি.ডি. জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন ( ইনজেকশন, মরফিন, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন।
এ ছাড়াও বিভিন্ন বৈধ ড্রাগ একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে মাদক। এসবও সেবন হচ্ছে দেদারসে। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারি চক্রের কুনজরের ফলে দেশে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বিশেষত হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা, ও ফেনসিডিল খুবই সহজলোভ্য হয়ে উঠেছে। পাড়া-মহল্লায় আনাচে কানাচে, সব জায়গায় হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক! বর্তমানে দেশে নানান সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে তরুণ -তরুণীদের মধ্যে মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় মাদকের ব্যাপাক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। মাদকের ব্যাপক চাহিদার সাথে সমানতালে মাদক সরবরাহ হওয়া এবং বাংলাদেশকে মাদকের রুট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বর্তমানে দেশের মাদক পরিস্থিতি খুবই জটিল। আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।এর মধ্যে মেথামফেটামিন, হেরোইন এবং সিন্থেটিক ওপিওড যেমন বুপ্রেনরফিন এবং ফেনসিডিলের পাচার অন্তর্ভুক্ত,' বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল।আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী,তালিকায় এশিয়ার যে ৫টি দেশের নাম ছিল, এর মধ্যে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের পরেই ছিল
মালদ্বীপ ও নেপাল। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে ছিল আফগানিস্তান ও মিয়ানমার। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ মিলিয়ন মাদকাসক্ত রয়েছে । তবে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই সাংখ্যা বর্তমানে ১ কোটিরও বেশি। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত, ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকসেবিদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই যুবক।বিভিন্ন পরিসংখ্যান হতে জানা যায়, বছরে মাদকের পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসায়ী, বাহক ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে প্রায় ২ লাখ ব্যক্তি। পারিশ্রমিক ও লাভ বেশি হওয়ায় প্রতি বছরই এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তৎপরতা থাকা সত্ত্বেও দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদক সেবন চলে। আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের মাদক চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে মাদকের রুট হিসেবে ব্যবহার করায় দেশে মাদকের চোরাচালান উদ্ববেগজনক হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের সাথে
ভারতের ৩০টি সীমান্ত জেলা এবং মায়ানমারের সাথে মোট ৩টি সীমান্ত জেলা রয়েছে। প্রতিবেশি এই দুই দেশের সাথে বাংলাদেশের মোট ৩২টি সীমান্ত জেলা দিয়েই দেশে প্রাণঘাতী মাদক বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, টাকি, বসিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁ, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রাণাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্তসংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর এলাকায় মাদক ঢুকছে। আর ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে
ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের চারটি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীতে। এ ছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁর ১৭টি স্পট দিয়ে মাদক প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, উত্তরে আসাম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে মেঘালয় এবং পূর্বে ত্রিপুরা ও মিজোরাম দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের (বার্মা) সঙ্গে সীমানা রয়েছে। বাংলাদেশের মোট ৩২টি জেলার সঙ্গে এ দুই দেশের সীমান্ত লাইন রয়েছে। এসব সীমানার ৩৮৬ স্পট দিয়ে দেদার মাদক প্রবেশ করছে। দেশে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করছে এর ৮৮ শতাংশ আসছে ভারত থেকে, মিয়ানমার থেকে আসছে ৮ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশে প্রবেশ করা মোট মাদকের ১৭ শতাংশ ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় আসছে। আর বাকি ৮৩ শতাংশ মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে যত মাদকদ্রব্য চোরাচালান হয়ে আসে তার মাত্র ১০ভাগ জব্দ করা হয়। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা সহ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে অন্যতম ভয়ংকর মাদকদ্রব্য কোকেনের চোরাচালানও আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে ২০১৯ সালে ১ কেজি, ২০২০ সালে ৩.৮৯৩ কেজি, ২০২১ সালে ১.৫৫কেজি, ২০২২ সালে ৪.৫৭ কেজি, ২০২৩ সালে ৪.৯৫৫কেজি এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেই আটক হয় ৮কেজি ৩০০গ্রাম কোকেনের চোরাচালান জব্দ করা । অর্থাৎ, এই মাদকদ্রব্যের চোরাচালান বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাড়ছে।
খবর২৪ঘণ্টা'র ভারতীয় সীমান্তের সূত্র থেকে জানা যায়, ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা গুলোতে মাদক চোরাকারবারিরা বেশিরভাগ সময়ই বিএসএফ'র সহযোগিতায় এ দেশে মাদক পাচার করে। ভারতীয় মাদকচক্র সীমান্ত এলাকায় কৃষিকাজ করার অজুহাত দেখিয়ে তাদের 'আধারকার্ড' দায়িত্বরত বিএসএফ কর্মকর্তাদের কাছে জমা রাখে এবং কৃষিকাজের নাম ভাঙিয়ে সুকৌশলে মাদক পূর্ব নির্ধারিত সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদকদ্রব্য রেখে যায়। দিন শেষে পুন:রায় ফিরে গিয়ে আবার তাদের আধারকার্ড ফেরত নিয়ে নেই। এইভাবে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ভারতীয় চোরাকারবারিরা বাংলাদেশ সীমান্তে মাদকদ্রব্য পৌঁছে দেয় এবং বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা হতে বাংলাদেশী মাদকচোরাকারবারিরা তাদের রেখে যাওয়া মাদক সংগ্রহ করে পৌঁছে দেয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। জবাবদিহি'র প্রতিনিধির এক ভারতীয় সূত্র হয়ে জানা যায় ভারতের বিভিন্ন বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন মাদক তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। মাদকের এই সমস্ত কারখানা সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত থাকায় অনেক সহজেই মাদক বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে। ফেনসিডিল তৈরির কারখানায় সিরাপ তৈরি হয় আর সেই সিরাপ কখনো ড্রামে, পলিথিনে বা অন্য কোনো কৌশলে বাংলাদেশে চোরাচালান করা হয়ে থাকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়ানোর জন্য মাদকচক্রগুলো প্রায়ই তাদের রুট পরিবর্তন করে মাদক পাচার করে থাকে। একেক সময় একেক রুট ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় মাদক চোরাচালান করা হয়ে থাকে। মাদক রুট সম্পর্কে অবগত থাকলেও মাদকদ্রব্য চোরাচালান নানান কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না বরং তা ক্রমশই বাড়ছে। সারাদেশের মতো রাজশাহীতেও মাদকের ছোবল পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে। ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা হওয়ায় রাজশাহীতে মাদকের লাগামহীন বিস্তার চোখে পড়ছে। বর্তমানে রাজশাহীর প্রায় প্রত্যেকটা এলাকায় হাত বাড়ালেই অতি সহজেই বিভিন্ন মাদক পাওয়া যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী) এর গা ছাড়া ভাব।বাংলাদেশে গবাদি পশুর পাচার ঠেকাতে (বিএসএফ)কে অনেক বেশি আগ্রাসী ভূমিকা পালন করতে দেখা দেয় কিন্তু, মাদক পাচার ঠেকাতে বিএসএফের গা-ছাড়া ভাব লক্ষ্যনীয়। এ কারণে রাজশাহীসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে মাদক চোরাচালান উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ সদস্য এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি কারণেও মাদক চোরাচালানে লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীতে মাদক চোরাচালান বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হলো গবাদি পশুর পাচার বন্ধ। এর ফলে কর্মহীন রাখালরা জীবিকার তাগিদে মাদক পাচার ও বহনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। করোনাকালে সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী কর্মহীন পরিযায়ী শ্রমিকদের (যারা অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করতেন) একাংশ সীমান্তে মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়েছে। এগুলো রাজশাহী সীমান্তে মাদক চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজনের দাবি বিএসএফ চাইলেই মাদক পাচার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে। প্রতিটি সীমান্তে তাদের ঘনঘন ফাঁড়ি আছে।
ভালো সড়ক নেটওয়ার্ক ও যানবাহন আছে। কিন্তু, মাদকপাচার বন্ধে তাদের কার্যত ভূমিকা না থাকায় বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত বিশেষ করে দেশের উত্তর ও পশ্চিম সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকের চোরাচালান ব্যাপক হারে বেড়েছে। মাদকবিক্রেতাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অঞ্চলে মাদকাসক্তদের হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফলে বর্তমানে এইখানে ক্রাইমরেটও পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী আটটি জেলায় অন্তত ছয় ধরনের মাদক পাচার হয়। এরপর সেসব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এগুলো হলো– হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, ট্যাপেন্টাডল, বুপ্রেনাফিন ইনজেকশন এবং এস্কাফ সিরাপ।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় কমপক্ষে ৭২টি ফেনসিডিল তৈরির কারখানা চালু আছে বলেও জানা যায়। এগুলো ধ্বংস করতে দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার চিঠি চালাচালি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে মাদক কারবারি ও ফেনসিডিল কারখানার তালিকা নিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। দুই দেশের মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে যৌথ অভিযানেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এর ইতিবাচক ফল দেখা যায়নি।
রাজশাহীর কোন সীমান্ত দিয়ে কোন কোন মাদক প্রবেশ করছে :
রাজশাহী বিভাগের ৪টি জেলার সাথে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। রাজশাহী বিভাগের সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলো হলো- রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও জয়পুরহাট। এই বিভাগের ৪টি জেলার সীমান্ত এলাকাগুলোর বিভিন্ন মাদক রুট ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন কায়দায় অনায়াসেই রাজশাহীর বুকে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করানো হচ্ছে। আর এইখান থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বত্র। অনায়াসেই মাদকদ্রব্য অনুপ্রবেশ করায় রাজশাহী বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে সারা দেশেরই মাদকের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ হয় এই রাজশাহীকে কেন্দ্র করে। দেশের মাফিয়াচক্রের একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে রাজশাহীর মাদককেন্দ্রীক। বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্ত পথ দিয়ে আসা হেরোইন ও ফেনসিডিলের ওপর নির্ভর গড়েই উঠেছে এ চক্রটি।
এইখানে মাদকব্যবসায়ীরা বেশভূষা পরিবর্তন করে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে গোপনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগের ডগায় বসে মাদক বিক্রয় করছে। সরবত, বাদাম, সিদ্ধ ডিম, ভাজাপোড়া বিক্রির আড়ালে, কখনো বা রিক্সা/ অটোরিক্সা চালানোর অভিনয় করে, বা ভিক্ষুকদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায়, মোড়ে, অলিতে গলিতে বিক্রি করা হচ্ছে গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিলও ইয়াবা সহ বিভিন্ন মাদক।
রাজশাহী জেলার চারটি উপজেলা গোদাগাড়ী, পবা, বাঘা ও চারঘাটের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তের দৈর্ঘ্য ৭২ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। যা ২৯টি ইউনিয়নের ৭৭৩টি মৌজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এরমধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলার নয়টি ইউনিয়েনের সঙ্গে সীমান্ত ১১ কিলোমিটার। পবা উপজেলার ৮টি ইউনিয়েনের সঙ্গে ২৯ দশমিক ৯০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। যা ভারত থেকে হোরইন এবং ফেন্সিডিল প্রবেশ করে। বাঘা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের সঙ্গে ১৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এখানে ফেন্সিডিল প্রবেশ করে। এছাড়া চারঘাট উপজেলার ৬ ইউনিয়নের সঙ্গে ১৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। যেখানে হেরোইন, ফেন্সিডিল অনুপ্রবেশ করে।
বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, ভারতের মুর্শিদাবাদ সীমান্ত এলাকা থেকে ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেট, গাঁজা, ফেনসিডিল ও হেরোইন রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতের, মুর্শিদাবাদের রাজানগর, আজিমপুর, উদয় নগর, সাগরপাড়া, রঘুনাথপুর, জগিরপাড়া, রামচন্দ্রপুর, লালগোলা এবং জুলজি থেকে রাজশাহীর সীমান্তে এই মাদক আনা হয় এবং রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর, গহমাবোনা, কাশিডাঙ্গা, শাহানপুর, বাঘার মীরগঞ্জ, হরিরামপুর, চারঘাটের ইউসুফপুর, মুক্তারপুর, টাংগন, রওথা এলাকা দিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। জবাবদিহি'র বিশেষ সূত্র হতে জানা গেছে, মাদক চোরাকারবারিরা ভারতের মোহনগঞ্জ সীমান্ত এলাকা থেকে রাজশাহীর চর খিদিরপুর, ভারতের ডিগ্রীগ্রাম হয়ে রাজশাহীর চর খানপুর, ভারতের রাণিনগর থানাধীন কাহারপাড়া
সীমান্ত এলাকা হতে রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের সোনাইকান্দি ও চর মাঝারদিয়া, ভারতের রাজা নগর দিয়ে চারঘাটের ইউসুফপুরে বিভিন্ন মাদক নিয়ে আসে। হেরোইন আর ফেনসিডিলের বড় রুট এসব সীমান্ত এলাকা। সূত্র হতে জানা গেছে চারঘাটের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে পুঠিয়ার শাহাবাজপুর, দুদুরমোড় কলনী(গুচ্ছগ্রাম), কান্দ্রা এলাকাগুলো তে ফেনসিডিল ও হেরোইন ছড়িয়ে পড়ে। চারঘাট রুট ব্যবহার করে মাদকদ্রব্য পুঠিয়া থানার জামেরিয়া, শিবপুর, বেলুপুকুর, ঝলমলিয়া, বানেশ্বর,মাহেন্দ্রা, পুঠিয়া বাজার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। সূত্রে জানা যায়, চারঘাটের নন্দনগাছি এবং পুঠিয়ার শাহাবাজপুর, দুদুরমোড় কলনী(গুচ্ছগ্রাম), কান্দ্রা এলাকাগুলো ফেনসিডিল পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়াও বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ও পাকুড়িয়া ইউনিয়নের চকরাজাপুর চর, চৌমাদিয়া চর, আতারপাড়া চর, টিকটিকি পাড়ার চর, লক্ষীনগর চর, দাদপুর চর, দিয়ার কাদিরপুর চর, নিচ পলাশির চর, পলাশি ফতেপুর চর, কড়ালী নওসারা সুলতানপুর চর, দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপ নগর ও চিলমারী ইউনিয়নের হবির চর, চিলমারীর চর, বৈরাগীর চর, মাজারদিয়ার চর, মরার চর, নতুন চর, মানিকের চর দিয়ে মাদক চোরাচালান করা হয়। এইখানে চরাঞ্চলের নারীদের ব্যবহার করে মাদক চোরাচালান করা হয় এবং দুই উপজেলা বাঘা ও চারঘাটে প্রবেশ করে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইনের বড় বড় চালান। এগুলো দেখভালের জন্য দুই উপজেলায় স্থাপন করা হয়েছে পাঁচটি বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ক্যাম্প কিন্তু, তারপরেও নানা কৌশল অবলম্বন করে পাচার হয়ে আসছে মাদক।
এই মাদক রুট গুলো রাজশাহী মহানগরী হতে নিকটবর্তী হওয়ায় এই সমস্ত মাদক অতি দ্রুত রাজশাহী শহরের কাশিয়াডাঙ্গা, গুড়িপাড়া, নবডাংগা, মোল্লাপাড়া, বুলোনপুর, ডাবতলা, তেরখাদিয়া, শিরোইল কলোনি, পদ্মা আবাসিক এলাকা, সিএন্ডবি'র মোড়, পঞ্চবটি, কেঁদুর মোড়, তালাই মারি, শিরোইল বাস টার্মিনাল, শিরইল কলোনী, খরবনা, শ্মশান ঘাট , টিকাপাড়া, খুলিপাড়া, বারো রাস্তার মোড়, মিজানের মোড়, কাটাখালি, ডাশমাড়ি, কাজলা, বিনোদপুর ও বেলপুকুর এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে । রাজশাহী মহানগরীতে মাদক পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে সর্বত্রই সর্বনাশী এইসমস্ত মাদকদ্রব্যে সয়লাব হয়ে পড়েছে। এই সমস্ত মাদক পরিবহন ও বিক্রয়ের কাযে ছোট বাচ্চা ও নারীদেরওব্যবহার করা হয়ে থাকে।
শুধু রাজশাহী সদর নয় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা রীতিমতো 'মাদকের রাজধানী" হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।
সীমান্ত ঘেঁষা এই উপজেলার পৌর শহরের একটি গ্রাম মাদারপুর বর্তমানে 'হেরোইন গ্রাম' নামে সকলের কাছে পরিচিত। রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত মাদকদ্রব্য হেরোইন পাচারের বহুল ব্যবহৃত রুট। ভারত থেকে দীর্ঘদিন ধরে এ সীমান্ত দিয়েই হেরোইন বাংলাদেশে ঢোকে। হেরোইনের ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র রাজশাহী জেলার সীমান্তবর্তী এ উপজেলা।
সূত্র মতে, ভারতীয় মাদক-মাফিয়াদের এক বড় ঘাটি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের রাজশাহীর জেলার সীমান্তের ওপারে ভারতের মুর্শিদাবাদ ও তার পাশের জেলা নদিয়া ও লালগোলায়। ভারতীয় সীমান্ত এলাকা লালগোলায় ফেনসিডিল ও হেরোইন তৈরির কারখানা রয়েছে। মূলত ভারতের লালগোলা ও মায়া সীমান্ত এলাকা থেকেই ফেনসিডিল ও হেরোইন মাদক স্বর্গ গোদাগাড়ীর বিভিন্ন সীমান্ত রুট এলাকা আঁচুয়া সিএন্ডবি, মাটিকাটা, ভগবন্তপুর, হাটপাড়া, মাদারপুর, মহিষালবাড়ি, বারুইপাড়া,রেল বাজার, সুইজগেট,রাজাবাড়ি, খরচাকা,, ডিম ভাঙ্গা, উজান পাড়া, প্রেমতলী, বিদিরপুর, নির্মলচর, ফরাদপুর, চর আষাড়িয়াদহ, সুলতানগঞ্জ ইত্যাদি এলাকা দিয়ে ফেনসিডিল ও হেরোইন চোরাচালান হয়।
মাদকের আরেকটি নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে নওগাঁ। এখানে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। প্রশাসন বলছে, মাদক রোধে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে তারা।কিন্তু, বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে ভারতের খুবই নিকটবর্তী নওগাঁ জেলা। এ জেলার সঙ্গে ভারতের নয়টি সীমান্ত অবস্থিত। হেরোইন, গাঁজা, ও ফেনসিডিল সাপাহার উপজেলার হাঁপানিয়া ও করমুডাঙ্গা সীমান্ত, পোরশা উপজেলার নীতপুর সীমান্ত এবং ধামইরহাট উপজেলার কালুপাড়া, চকিলাম, চকচণ্ডি, বস্তাবর, শিমুলতলী ও তালান্দার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। বিশেষ সূতে জানা যায়, নওগাঁর সাপাহার উপজেলার পাতাড়ি, হাপানিয়া, করমুডাঙ্গা, পোরশা উপজেলার নীতপুর, রানীনগর, ধামাইরহাট উপজেলার ধামাইরহাট, কালুপাড়া, চকিলাম, আগ্রাদ্বিগুণ ও উমার হলো মাদক পাচারের নিরাপদ রুট।
মাদকের আরেকটি নিরাপদ রুট হলো রাজশাহীর চাঁপাইনবয়াবগঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিনই এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ব্যবহার করে আসছে হেরোইন, ফেনসিডিল ও ইয়াবা। মাদক কারবারিরা এই জেলার সীমান্তকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। যদিও বিজিবির দাবি, চোরাচালান রোধে সীমান্তে আছে কড়া নজরদারি। এই জেলার চারটি উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। বিস্তীর্ণ সীমান্তের ২৭টি রুট দিয়ে আসছে মাদকদ্রব্য। এ ২৭টি রুট বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তিনটি ব্যাটালিয়নের অধীনে। সূত্রটি আরো জানায়, ৫৩ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় ৮টি, ৫৯ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ ১৬ এবং ১৬ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ ৩টি এলাকা দিয়ে আসছে মাদকদ্রব্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিবগঞ্জ,ভোলাহাট ও গোমস্তাপুর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি আসে ফেনসিডিল। আর সদর উপজেলার রুটগুলো দিয়ে আসে হেরোইন। মাদক কারবারিদের মতে, জেলায় মাদকের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে ফেনসিডিল ও হেরোইন। বিশেষ সুত্রে জানা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মোহাব্বতপুর, মল্লিক সুলতান, নাজিরখালি, গোপালনগর, বাজিতপুর, সাবঘাট ও নূরপুর থেকে চাঁপাইনবয়াবগঞ্জের কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট, শিবগঞ্জ,পত্নীতলা, গোমস্তাপুর, কানসাট, আজমতপুর, মনাকষা, চাকপাড়া, কামালপুর, শিয়ালমারা, ভাটিয়া বিল, তেলকুপি,রঘুনাথপুর, ওয়াহেদপুর, জুহুরপুরটেক ও ফতেহপুর দিয়ে ফেনসিডিল ও বিভিন্ন ইঞ্জেকশন বাংলাদেশে ঢুকে। এছাড়াও চাহিদা অনুসারে ইয়াবার চালানও এই রুট দিয়ে প্রবেশ করে।
সূত্র খবর২৪ঘণ্টাকে কে জানায়, নওগাঁ সদর উপজেলার শাহাজানপুর ইউনিয়নের হাকিমপুর ও দুর্লভপুর, আলাতুলি ইউনিয়নের কোদালকাটি ও বকচর, চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাখের আলী, শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের শিংনগর, দুর্লভপুর ইউনিয়নের মনোহরপুর, পাঁকা ইউনিয়নের ওয়াহেদপুর সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি হেরোইন এবং ফেনসিডিল আসে শিবগঞ্জের বিনোদপুর ইউনিয়নের কিরণগঞ্জ, কালীগঞ্জ, জমিনপুর, শাহবাজপুরের শ্মশানঘাট, আজমতপুর, উনিশবিঘী, চকপাড়া, তেলকুপি, শিয়ালমারা ও দাইপুকুরিয়া ইউনিয়নের কামালপুর, ভোলাহাট উপজেলার ভোলাহাট সদর ইউনিয়নের চামুসা, হোসেনভিটা, গিলাবাড়ী, বিলভাতিয়া ও গোহালবাড়ী ইউনিয়নের আলী সাহপুর ও দলদলি ইউনিয়নের পোল্লাডাঙ্গা-ময়ামারি সীমান্ত দিয়ে। গোমস্তাপুর উপজেলার রোকনপুর ও বাঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের শিবরামপুর দিয়ে আসে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য।সংশ্লিষ্টদের মতে, ভৌগোলিক কারণেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ মাদকের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
রাজশাহীতে মাদকের অন্যতম আরেকটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলা জয়পুরহাট। ভারতের ৪ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের জয়পুরহাটে বিভিন্ন মাদক প্রবেশ করছে। পাশ্চিমবঙ্গের ঘোষাইপুর, গয়েশপুর, চিংগিশ পুর, কিসমত ও রামকৃষ্ণপুর দিয়ে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার চেঁচড়া, আতাপাড়া, উত্তর গোপালপুর সীমান্ত, , রামকৃষ্ণপুর এবং ধরঞ্জি দিয়ে বুপ্রেনরফিন ও অ্যাম্পুল ইঞ্জেকশন, ফেনসিডিল, ট্যাপান্টাডল ও অন্যান্য মাদক প্রবেশ করছে।
মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কেন কাজ করছে না :
মাদকের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। প্রশাসনিক, আইনগত, বিচারিক ও সামাজিকভাবে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধকে জিরো টলারেন্স বলে। তথ্যমতে, স্থানীয়ভাবে যারা মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাদের আটক করা হচ্ছে, তারা মাদকসেবী ও সাধারণ খুচরা বিক্রেতা। যারা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বা মূল পাচারকারী, তারা গ্রেফতার হচ্ছেন না। তাদের কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন আবার কেউ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকায়ই আছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো কোনো এলাকার পুলিশ সদস্যদের যোগাযোগ থাকায় লোক দেখানো অভিযানে সাধারণ মানুষকে করা হচ্ছে হয়রানি আর মাদক ব্যবসায়ীরা আড়ালে লুকিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, বাংলাদেশে মাদকের বিস্তারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একশ্রেণির কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি গ্রুপের হাত আছে। তারাই মাদক ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থেকে মাদক ব্যবসা করছে মূলত রাঘববোয়ালরা। নামমাত্র মাদক বিরোধী অভিযানে মাঝেমধ্যে কিছু চুনোপুঁটিস ধরা পড়লেও বীরদর্পে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যায় 'মাদকের গড ফাদাররা'। মাদক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাই ঠিকই কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদের কালো টাকার ক্ষমতায় সব অভিযান ভেস্তে যায়। মাদক ববসা তা কে কেন্দ্র করে এই সমস্ত এলাকায় দালাল চক্র মাথা উঁচিয়ে উঠেছে। এই সমস্ত দালালদের সাথে গোপনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সক্ষ্যতা গড়ে উঠেছে। যখন কোনো মাদক ব্যবসায়ী কে আটক করা হয় তখনই খবর চলে যায় দালাল চক্রের কাছে। দালালদেএ মাধ্যমে মাদক কারবারির পরিবারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে চুক্তির মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয় আটককৃত মাদক ব্যবসায়ীদের। এইভাবেই জিরো টলারেন্স নীতির মধ্যেই কিছু অসাধু কর্মকর্তার জন্য মাদকদ্রব্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে রাজশাহীসহ পুরো দেশ এবং মাদকের ভয়াল থাবায় গ্রাস হচ্ছে হাজার হাজার তরুণ প্রজন্ম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা খবর২৪ঘণ্টাকে জানান, কিছু ঘুষখোর অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় নেতাদের প্রভাবের কারণে মাদকের চোরাচালান বা বিক্রয় বন্ধ সম্ভব হচ্ছে না। তবে,এটিই একমাত্র কারণ না। বর্ডারের ওপারের সীমান্ত রক্ষী বিএসএফ এর উদাসীনতা এবং পর্যাপ্ত লোকবল ও সোর্সের অভাবেও মাদক চোরাকারবারিদের নেটওয়ার্ক নষ্ট করা যাচ্ছে না। তিনি আরও জানান, মাদকের এই চক্রটি অনেক বিস্তৃত। বিস্তৃত এই বিশাল নেটওয়ার্ক নষ্ট করার জন্য আমাদের অনেক সোর্স প্রয়োজন। সোর্সের মাধ্যমে আমরা অনেক খবর পেয়ে থাকি এবং তা কাজে লাগিয়ে অভিযান পরিচালনা করি। মাদকের এত বড় নেটওয়ার্ককে পরাস্থ করার জন্য আমাদের তেমনই বড় সোর্স প্রয়োজন । কিন্তু, পর্যাপ্ত সোর্স ব্যবহার করার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ আমাদের দেওয়া হয় না। আমরা তো আমাদের নিজেদের বেতন থেকে সোর্স লাগাতে পারবো না এটা সম্ভব না। আমাদের প্রয়োজনীয় তহবিল বাড়ানো হলে এবং রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত হয়ে কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া হইলে অবশ্যই জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করা সম্ভব হবে।
এই বিষয়ে রাজাশাহী মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলমগীর হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি খবর২৪ঘণ্টা কে জানান, সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় রাজশাহী পবের আশেপাশের উপজেলা গুলোতে মাদকের আনাগোনা বেশি। তবে তিনি ও তার টিম জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মাদকদ্রব্য চোরাচালান ও বিক্রয় বন্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গোয়েন্দা উইংসহ মোট ৩টি টিম মাদক নির্মুলে কাজ করছে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে তারাও এই অঞ্চলে মাদক নির্মুলের জন্য কাজ করছেন। নিয়মিত মোবাইল কোর্টের মাধমে অভিযান পরিচালনা করে মাদক উদ্ধার সহ দোষীদের আটক করে মামলা দায়ের করা, মামলা সুষ্ঠু পরিচালনা করার জন্য নিয়মিত আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ নিশ্চিত করার কাজ করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও জানান, গতমাসে বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে ৫ কেজি ১০০গ্রাম হেরোইন ও তার পূর্বে ১০০কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রয়োজনীয় লোকবল সংকট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের প্রয়োজনীয় লোকবল সংকট সহ তাদের যানবাহনের সংকট রয়েছে।তিনি বলেন তাদের ১টি মাত্র পিক-আপ গাড়ি রয়েছে। কিন্তু, তার পরেও তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। নিয়মিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শুধুমাত্র মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (রাজশাহী) ১০০এর কাছাকাছি মামলা দায়ের করে। তিনি আরও জানান 'জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তাদের আরও সেট-আপ চালু হইলে উপজেলা পর্যায়ে মাদকচক্র কে নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ হবে। '
এই বিষয়ে রাজশাহীর অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশনস) সাইফুল ইসলাম এর সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলে তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।
জ/ন
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- [email protected], মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০