খবর২৪ঘন্টা স্পোর্টস ডেস্ক: মানিক জোড়। বাংলায় এই দুটির শব্দের অর্থে যে ব্যাপকতা, ইংরেজিতে ডুয়ো (Duo) শব্দের অর্থের মধ্যে এত ব্যাপকতা নেই। ইংলিশ ক্রিকেটে জেমস অ্যান্ডারসন আর স্টুয়ার্ট ব্রডকে মানিক জোড় বললে কী কম বলা হবে?
সম্ভবত নয়। কারণ, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এ ধরনের কোনো বোলিং জুটি কী এর আগে কখনো দেখা গেছে? কিংবা ভবিষ্যতেও কী এমন দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে? বোদ্ধাদের কাছে অন্তত তেমন মনেই হচ্ছে না।
এই পেস জুটির একজনের উইকেট ৫৮৯, অন্যজনের ৫০১। যোগফল? ১০৯০ উইকেট। কোনো প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে দুই প্রান্ত থেকে এমন দু’জন যখন বোলিং শুরু করেন- একবার ভাবুন, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপেই যেন ইতিহাস দৌড়ে আসে বলটা ডেলিভারি দেয়ার জন্য।
১০৯০ উইকেট জুটির একসঙ্গে দুই প্রান্ত থেকে বোলিং করার ইতিহাস সম্ভব আর কখনো তৈরি হবেও না। বিশেষত্ব আরও আছে। দু’জনই পেসার। শোয়েব আখতার কিংবা ব্রেট লি’র মত হয়তো এক্সপ্রেস ডেলিভারি দেন না তারা। কিন্তু বলে তো গতি আছে। অথচ, দু’জনের খেলা টেস্ট সংখ্যার দিকে তাকালে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য যে কারো।
২০০৩ সাল থেকে ক্যারিয়ার শুরু করা জেমস অ্যান্ডারসন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্ট মিলিয়ে খেলেছেন মোট ১৫৩টি টেস্ট। আর স্টুয়ার্ট ব্রড খেলেছেন ১৪০তম টেস্ট। যোগফল, ২৯৩ টেস্ট। কল্পনা করা যায়? প্রথম আলোর সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই জুটির কথা লিখতে গিয়ে যখন দু’জনের টেস্টের যোগফল মিলিয়ে দেখলেন, তখন তার বিস্ময় সমী ছাড়িয়ে গেলো। লিখলেন, ‘কীভাবে সম্ভব! ওরা না পেস বোলার!! এক্সপ্রেস না হলেও বলে গতি তো একেবারে খারাপ নয়।’
ওয়ালশ-অ্যামব্রোস জুটিও এক সময় বিখ্যাত ছিল। একই সময় বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানের ওয়াসিম-ওয়াকার জুটি। পেস আর স্পিন সমন্বয়ে জুটি গড়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ায় গ্লেন ম্যাকগ্রা এবং শেন ওয়ার্নের। কিন্তু পেস জুটি হিসেবে পরিসংখ্যানের বিচারে অ্যান্ডারসন-ব্রড জুটির কাছে কোনো কিছুই তুলনা চলে না। শুধু উইকেট সংখ্যার বিচারে নয়, দু’জন মিলে খেলা টেস্টের সংখ্যা ৩০০ ছুঁই ছুঁই- এমন পেস জুটির দেখা তো কখনোই মেলেনি।
উৎপল শুভ্র ফেসবুকে দেয়া পরিসংখ্যানে পার্থক্যটা সুন্দর করে দেখিয়ে দিয়েছেন, ‘কোর্টনি ওয়ালশ ১৩২ টেস্ট খেলেছেন, কপিল দেব ১৩১টি। কপিলেরও ১৩২ টেস্টই হতো, সেটিও হতো টানা, যদি "দায়িত্বজ্ঞানহীন" শট খেলার অপরাধে একটা টেস্ট থেকে বাদ না পড়তেন। পেসারদের দীর্ঘজীবিতার এই "ওয়ালশীয় ও কপিলীয়" রেকর্ড কোনোদিন ভাঙবে বলে ভাবা যায়নি। ম্যাকগ্রা একটু ঝামেলা করার সম্ভাবনা জাগিয়ে থেমে গেছেন ১২৪ টেস্টে।’
পেস বোলার হিসেবে অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ার ১৭ বছরের। ব্রডের ক্যারিয়ার ১৩ বছরের। এখানে যোগফলটা দাঁড়াচ্ছে ৩০ বছর। যদিও, পরিসংখ্যানে সময়ের যোগফলটা কখনোই ধরা হয় না। তবে, এমন একটা সময়ে ক্যারিয়ার অতিবাহিত করছেন অ্যান্ডারসন-ব্রড, যখন তাদেরকে সাবেক হয়ে যাওয়া অন্যসব নামি-দামি বোলারদের, বিশেষ করে যাদের উইকেট ৫০০ প্লাস, তাদের চেয়ে একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বেশি।
সেই চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জ। উৎপল শুভ্র খুব সুন্দর করে এর ব্যাখ্যাটা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘…তবে এঁদের তো বড় একটা সুবিধা ছিল। টি-টোয়েন্টি নামের “প্রতিপক্ষের” সঙ্গে লড়তে হয়নি। রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দীর্ঘজীবী হওয়ার সুতীব্র ইচ্ছা, প্রাণশক্তি এবং একই সঙ্গে টেস্ট খেলার রোমাঞ্চটা শুষে নিতে পারেনি সেটি। কিন্তু অ্যান্ডারসন-ব্রডকে তো টি-টোয়েন্টির পৃথিবীতেই শ্বাস নিতে হয়েছে। সেই বায়ুমন্ডলে থেকেও যে অ্যান্ডারসন-ব্রড অনন্তকাল খেলে যাচ্ছেন, সেটির বড় কারণ টি-টোয়েন্টির ভাইরাস সেভাবে তাদের আক্রান্ত করেনি। কারণ তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া আছে। সময়মতো ভাইরাসের ভ্যাকসিনটা দিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা অবশ্যই ইসিবির।’
কি সেই ভ্যাকসিন? প্রথম আলোর সাবেক ক্রীড়া সম্পাদকের লেখার পরের অংশেই রয়েছে তার উত্তর, ‘টি-টোয়েন্টি তাদেরই (ইসিবি) আবিষ্কার। মাঝখানে স্ট্যানফোর্ডকে নিয়ে চরম ফাতরামিও ইসিবিই করেছে। করোনা না এলে “দ্য হান্ড্রেড” নামে আরেকটি সার্কাসও এতদিনে শুরু হয়ে যেত…। তবে এত কিছুর মধ্যেও টেস্ট ক্রিকেটটাকে সবার ওপরেই রেখে এসেছে তারা। টেস্ট ক্রিকেটটাকে ইংলিশরা হৃদয়ে ধারণ করে। আর করে বলেই ইসিবি টেস্ট ক্রিকেটারদের যত্ন করে। যেমন সম্মান দিয়ে, তেমনি অর্থ দিয়েও। এ কারণেই আমরা অবিশ্বাসে চোখ কচলে দেখি, একটা টেস্ট ম্যাচে দুই প্রান্ত থেকে যে দুই পেস বোলার বোলিং করছে, তাদের খেলা টেস্ট যোগ করলে ২৯৩ হয়, উইকেট যোগ করলে ১০৮৯ (১০৯০ হবে)!’
২০০৩ সালের মে মাসে, লর্ডসে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। অভিষেক ইনিংসেই ৫ উইকেট নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নিজের আগমণ বার্তা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। যদিও দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট পাননি। কিন্তু অ্যান্ডারসন প্রথম ইনিংসেই প্রমাণ করেছেন তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি। লম্বা রেসের ঘোড়া।
২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলেই ওয়ানডে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন জেমস অ্যান্ডারসন। টি-টোয়েন্টিকে তো বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন তারও অর্ধযুগ আগে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলে। একদিনের ফরম্যাটে ১৯৪ ম্যাচে তিনি উইকেট নিয়েছেন ২৬৯টি। আর টি-টোয়েন্টিতে নিয়েছেন ১৯ ম্যাচে ১৮ উইকেট। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত তার উইকেট সংখ্যা (তিন ফরম্যাটে) ৮৭৬টি।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে স্বাগতিকদের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক স্টুয়ার্ট ব্রডের। অ্যান্ডারসনের মত একটা ইমপ্রেসিভ ছিল না তার অভিষেক। এক ইনিংসে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, মাইকেল ভেন্ডর্টদের বিপক্ষে বোলিং করে মাত্র একটি উইকেট নিতে পেরেছিলেন ব্রড। তবে সবচেয়ে কম ইকনোমিতে বোলিং করে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
তবে ২০০৭ প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের যুবরাজ সিংয়ের হাতে ৬ বলে ৬ ছক্কা খেয়ে যে স্টুয়ার্ট ব্রড হারিয়ে যাননি সেটাই বিস্ময়ের। এখনও পর্যন্ত সমালোচকরা ব্রডের সেই দুর্বলতা সামনে টেনে নিয়ে আসে। কিন্তু ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি ছেড়ে দেয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। মনযোগ দেন ওয়ানডে এবং টেস্টের দিকে। ২০১৬ সালে ওয়ানডেও পুরোপুরি ছেড়ে দেন। হয়ে গেলেন পুরোদমে টেস্ট বোলার। যার মূল্য পেলেন তিনি, টেস্টে ৫০০ প্লাস উইকেট নিয়ে।
ওয়ানডেতে ব্রডের উইকেটের সংখ্যা ১২১ ম্যাচে ১৭৮টি এবং টি-টোয়েন্টিতে ৫৬ ম্যাচে নিয়েছেন ৬৫ উইকেট। সব মিলিয়ে তার মোট উইকেটের সংখ্যা ৭৪৪টি।
সুতরাং, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের এই মানিক জোড়ের মোট উইকেটের সংখ্যা সর্বমোট ১৬২০টি (৮৭৬+৭৪৪)। এমন মানিক জোড় কি আর কখনো জন্ম নেবে ক্রিকেটের ইতিহাসে?
খবর২৪ঘন্টা/নই
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- [email protected], মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০