পুঠিয়া (রাজশাহী) সংবাদদাতাঃ রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় মুঠোফোনে অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিন্ন-ভিন্ন নামের প্রায় ১০ থেকে ১২টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। তবে বেশিভাগ যুবসমাজ আসক্ত হয়েছে ওয়ানএক্সবেট অ্যাপ এ। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এই খেলা শুরুর পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছে।
প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়াচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। ওয়ানএক্সবেটসহ বিভিন্ন অনলাইন গেমস এর লোভনীয় ফাঁদে বেশিরভাগ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী,যুবকসহ বিভিন্ন বয়সী শ্রেণি-পেশার মানুষ আসক্ত হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের নেপথ্যে পাঁচআনী রাজবাড়ী বাজার এলাকার ৬জন গ্যাম্বলিং মাষ্টার এজেন্টসহ ২০টিরও বেশি সাব-এজেন্টের মাধ্যমে চলছে লক্ষ লক্ষ টাকার অবৈধ অনলাইন ব্যবসা। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ।
এছাড়াও উপজেলার কৃষ্ণপুর , দুদুরমোড়, ঝলমলিয়া, নিমতলা, ধোপাপাড়া, বানেশ্বর, বিড়ালদহ,কাঠের আড়ত,পুঠিয়া বাস স্ট্যান্ড, ঢাকাপাড়া, পুঠিয়া ফায়ার স্টেশন সংলগ্ন, বারইপাড়া খাঁপাড়াসহ প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় এই জুয়ার গ্যাম্বলিং মাষ্টারসহ সাব-এজেন্ট রয়েছে।
এসব এজেন্টা হলো পুঠিয়া রাজবাড়ী এলাকার জালাল মুন্সীর ছেলে মাহমুদুল হাসান বাবু, কৃষ্ণপুর ঘোষপাড়া এলাকার রমজান আলীর ছেলে সুজন ইসলাম ডন,বারইপাড়া এলাকার খোকন আলীর ছেলে আলমগীর হোসেন খাঁ,পুঠিয়া বাজার এলাকার নারায়ন কুন্ডুর ছেলে সূর্য কন্ডু, ত্রিমোহনী বাজারের ফ্লেক্সি দোকানদার সালাম ড্রাইভারের ছেলে হানিফ, ধোপাপাড়া এলাকার মৃত আমিন হোসেনের ছেলে শামিম আহম্মেদ ও বালাদিয়াড় এলাকার মাদক সম্রাট। একাধিক মাদক মামলার আসামি বিপুল চৌকিদার ওরফে বিপুল, ধোপাপাড়া কলেজ এলাকার ইমাম হোসেনের ছেলে সোহেল, কলোনীপাড়া এলাকার মসলেম উদ্দিনের ছেলে হাসিবুল,কাঠের আড়ৎ এলাকার রাব্বি, পুঠিয়া শেখ রাসেল শিশু পার্ক সংলগ্ন এলাকার আনোয়ারের ছেলে মহন, পুঠিয়া বাজার এলাকার নারায়ন কুন্ডুর ছেলে সাগর কুমার কন্ডুসহ বেশ কয়েকজন। এতে করে শেখ রাসেল শিশু পার্কের প্রধান ফটকসহ প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও মারাত্মক ভাবে বিস্তার লাভ করছে এই অপরাধমূলক অনলাইন গেমটি।
পুঠিয়া থানার ২০০গজ দূরত্বে পাঁচানি বাজারে এজেন্টদের বাড়ি হলেও বছরের পর বছর এটি চলমান আছে। গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। অনলাইন জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে টাকা-পয়সা হেরে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পথে বসতে চলেছে অসংখ্য পরিবার।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পুঠিয়ার বারইপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি এনজিওতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১০ লক্ষ্ টাকা ওয়ানএক্সবেড অ্যাপস এর মাধ্যমে হেরে যায়। তৎক্ষণাৎ টাকা পরিষদ না করার কারণে চাকরি হারায় সে কর্মকর্তা এবং পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির পাওনা টাকা ফেরত পেতে ভুক্তভোগীর নামে মামলার নোটিশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কোনো উপায় না পেয়ে তখন জমি বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন তিনি। এছাড়াও শীলমাড়িয়া ইউনিয়নের মোল্লাপাড়া বাজারে ১৬ বছরের এক শিশু অনলাইন জুয়ায় টাকা হারার পর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। বানেশ্বর তাতারপুর এলাকায় বেসরকারি সমিতি থেকে কিস্তির টাকা তুলে একদিনেই সব টাকা হেরে তিনিও আত্মহত্যা করেন। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় গেমটির জন্য অনেকেই হচ্ছে নিঃস্ব। ঋণের বোঝা বইতে না পেরে একাধিক ভুক্তভোগী ভিটে-মাটি ছাড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
একই গ্রামের এক নারী অভিযোগ করে বলেন যেদিন থেকে আমার স্বামী মোবাইলে জুয়া খেলতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই সংসারে অশান্তি শরু হয়েছে। জুয়াতে হেরে বাসায় এসে তার স্বামী তাকে মারধর করে। ৬ বছরের একটি ছেলে সন্তান আছে তাকেও মারপিট করে। কাছে টাকা না থাকলে ঘরের টিভি ফ্রিজ বিক্রি করতে যায়। বাধা দিলে সেগুলো ভেঙে তছনছ করে ফেলে। জুয়ার নেশায় মনে হয় তার স্বামী পাগল হয়ে গেছে। মাদক সেবনও করে তার স্বামী।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের আরেকজন নারী অভিযোগ করে বলেন, "'স্বামী জুয়ায় নেশায় বুঁদ হয়ে স্বর্ণ অলংকার ও শশুরের বাড়ি থেকে দেওয়া মোটরসাইকেল বন্ধক রেখে টাকাগুলো হেরে যায় তার স্বামী। শুধু তাই না মানুষের কাছে সুদের উপরে টাকা নিয়েও হেরে যায়। এখন সুদের টাকা পরিশোধ করব কিভাবে?এলাকায় মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়েছে। তাই স্বামীর সংসারে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে সে।
অনলাইন জুয়া নেশা মস্তিষ্কের জন্য খুব বেশি ভয়াবহ। কারণ গেমসটি না খেলতে পারলে তাদের নাকি ভালো লাগেনা, টেনশন হয়, মাথার মস্তিষ্ক লন্ডভন্ড হয়ে যায় এমন তথ্য দিয়েছেন সাব-এজেন্ট ও নিয়মিত খেলোয়াড় শ্রী মিঠন কুমার। তিনি আরও বলেন যে বাক্তি গেমসটিতে আসক্ত সে টাকার জন্য মানুষকে হত্যা করতেও দিধা করবে না।
স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, জুয়ার অর্থ উপার্জনে পুঠিয়ার যুবসমাজ বর্তমানে ঝুকেছে বিভিন্ন অপরাধ মূলক কাজে। বর্তমানে এ উপজেলাতে প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি,ছিনতাই,মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ নানান ধরনের অপরাধ। চুরি-ছিনতাই ও মাদক কারবারির অত্যাচারে সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ। এসব কারণে এলাকায় বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে। তরুণ-তরুণী সকলের কাছে এখন "স্মার্টফোন" থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঝুকছে অনলাইন জুয়ার দিকে।
নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক (ওয়ানএক্সবেড) অ্যাপস এর গ্যাম্বলিং মাস্টার এজেন্ট বলেন, পাঁচানি রাজবাড়ী বাজার এলাকার জালাল মুন্সির ছেলে মাহমুদুল হাসান (বাবু) সর্বপ্রথম পুঠিয়াতে গ্যাম্বলিং মাস্টার এজেন্ট হয়। বাবু বর্তমানে প্রায় কোটি টাকার মালিক। পুলিশ প্রশাসন তাদেরকে কিছু বলেনা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন এমনি থানা পুলিশের চাপ নেই। এজেন্ট বাবু সাবেক প্রতিমন্ত্রীর কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারার ঘনিষ্ঠ ছিল তাই কিছু বলেনি।
অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্মার্টফোনে নির্ধারিত কয়েকটি অ্যাপস ডাউনলোড করে সেখানে জুয়া খেলা চলে। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়।
এ বিষয়ে পুঠিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কবির হোসেন বলেন, সাবেক কর্মকর্তা এ বিষয়ে কি করেছে তা বলতে পারবোনা। আমি এ থানায় নতুন এসেছি অনলাইন জুয়ার বিষয়টা জানতাম না। যেহেতু আজ জানতে পারলাম আমি অফিসারদের সাথে আলোচনা করে অবশ্যই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পুঠিয়া সার্কেল রাজিবুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। অনলাইন জুয়া অপরাধ এটা আমার জানা নেই।
অনলাইন জুয়া বিষয়ে জানতে পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর হোসেন নির্ঝর এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জুয়া আইনের চোখে অবশ্যই অপরাধ। পুলিশ ইচ্ছে করলে আসামিদের গ্রেপ্তার করে নিয়মিত মামলা দিতে পারে। এছাড়াও আসামি গ্রেপ্তার করে আমার কাছে নিয়ে আসলে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিবো।
বিএ..
উপদেষ্টা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম জুলু, প্রকাশক ও সম্পাদক : নাজমুল ইসলাম জিম, অফিস : আর,ডি,এ মার্কেট ২য় তলা,সাহেব বাজার, ঘোড়ামারা, বোয়ালিয়া, রাজশাহী। ই-মেইল:- [email protected], মোবাইল: ০১৭১১-৯৪৩৪৭১, ০১৭১৫০৫৭৪৪০