অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলো আরও। ৫৮ বছর পেরিয়েও ঘুচলো না শিরোপার আক্ষেপ। পরপর দুবার খুব কাছ গিয়েও ইউরোর রূপার কাপটা দেখা হলো না ছুঁয়ে। এবারও খালি হাতে ঘরে ফিরতে হচ্ছে বেদনার বিষে নীল হয়ে। ব্রিটিশদের এমনই আক্ষেপে পুড়িয়ে ইউরোপীয়ান ফুটবলের রাজার আসনে চড়ে বসল স্পেন।
ইউরো-২০২৪ এর ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলের হারিয়ে রেকর্ড চতুর্থ শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতলো স্পেনের তরুণ প্রজন্ম; সেটাও আবার জার্মান ভূমিতে। এই জার্মানির সঙ্গেই ইউরোপীয়ান ফুটবলের রাজার আসন এতদিন ভাগাভাগি করে আসছিল তারা। ইংল্যান্ডের সঙ্গে তাই জার্মানদের জন্যও হয়তো শোকেরই একটি দিন আজ।
আজকের ম্যাচের আগে ইউরোর সিলভার ট্রফিটা প্রথমবারের মতো ছুঁয়ে দেখার হাতছানি ছিল ইংল্যান্ডের সামনে; বিপরীতে চতুর্থ ইউরো জিতে এককভাবে ইউরোপের রাজা হওয়ার সুযোগ ছিল স্পেনের সামনে। ইতিহাস গড়ার লক্ষ্য নিয়ে দুদলই ইউরো-২০২৮ এর ফাইনাল ম্যাচটা খেলতে নামে বার্লিনের অলিম্পিয়া পার্কে।
ম্যাচের শুরু থেকে বল দখলে দাপট দেখালেও ব্রিটিশদের গোলমুখে গিয়ে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না ইয়ামাল-অলমো-উইলিয়ামসরা। অন্যদিকে দুর্দান্ত স্প্যানিশ টিকিটাকায় ফ্যাকাশে ছিলেন কেইন-বেলিংহ্যাম-সাকারাও। দেখে মনে হচ্ছিল, আগ্রাসী হয়ে বিপদ ডাকতে রাজি ছিলেন না লুইস দে লা ফুয়েন্তে বা গ্যারেথ সাউথগেট কেউই।
ম্যাচের ১২তম মিনিটে ডি বক্সের সামান্য ভেতর থেকে নিকো উইলিয়ামসের গোলমুখে নেওয়া শট ব্লক করেন ইংলিশ ডিফেন্ডার জন স্টোনস। পরের মিনিটেই ইংলিশ ডি বক্সে উড়ে আসা নিকো উইলিয়ামসের ক্রসে বাইসাইকেল কিক নেন স্প্যানিশ ডিফেন্ডার নরম্যান্ড। কিন্তু গোলবারের অনেক বাইরে দিয়ে চলে যায় বল।
২৮ মিনিটে আবারও সুযোগ পায় স্পেন। এবার ফাবিয়ান রুইজের শট ব্লক করে দেন ইংলিশ ডিফেন্ডাররা। ৩৬ মিনিটে দানি ওলমোর দূরপাল্লার শট চলে যায় গোলবারের অনেক বাইরে দিয়ে।
৪৪ মিনিটে হ্যারি কেইনের ডিবক্সের ভেতরে নেওয়া বুলেট গতির শট ব্লক করেন স্প্যানিশ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি। ৪৫ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে ডেকলাইন রাইসের ক্রসে ফিল ফোডেন বা পায়ের শট নিলে অনায়াসেই সেটিকে গ্লাভসবন্দি করেন উনাই সিমন।
পুরো প্রথমার্ধে বলার মতো সুযোগ ছিল এগুলোই। ৭০ শতাংশ বল দখলে রেখেও ইংলিশ রক্ষণে তেমন একটা ভয় ধরাতে পারেননি ফুয়েন্তের শিষ্যরা। অন্যদিকে কেইন-বেলিংহ্যাম-সাকারাও ছিলেন অনেকটাই নিষ্প্রভ। দুদলের এমন অতি সাবধানী ফুটবল খেলায় ম্যাড়মেড়ে গোলশূন্য এক প্রথমার্ধই দেখতে বাধ্য হয় ফুটবল বিশ্ব।
তবে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই দারুণভাবে জমে উঠে ম্যাচ। শুরুতেই এগিয়ে যায় স্পেন। ৪৭তম মিনিটে লামিন ইয়ামালের ক্রসে বক্সের বাঁ দিক থেকে বল জালে জড়িয়ে দেন নিকো উইলিয়ামস। দুই মিনিট বাদেই গোলের আরও এক সুযোগ তৈরি করেন তরুণ এই স্প্যানিশ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। কিন্তু ডানপাশের পোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায় ড্যানি ওলমোর বাঁ পায়ের শট। চার মিনিটের ব্যবধানে আরও একবার ইংলিশ রক্ষণে শঙ্কা জাগান নিকো উলিয়ামস। কিন্তু বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া তার দুর্দান্ত গতির শটটা এবারও চলে যায় পোস্টের পাশ দিয়ে।
এদিকে ম্যাচের ফেরার জন্য মরিয়াভাবে সুযোগ খুঁজতে থাকে ইংল্যান্ডও। কিন্তু কিছুতেই স্প্যানিশদের কাছ থেকে বল দখলে নিয়ে সমীহ জাগানিয়া আক্রমণ শানাতে পারছিলেন না সাউথগেট শিষ্যরা। উপায় না পেয়ে ৬১তম মিনিটে দলের মূল স্ট্রাইকার হ্যারি কেইনকে তুলে নিয়ে ওয়াটকিন্সকে মাঠে নামান ইংলিশ কোচ। তাতে আক্রমণের ধার কিছুটা বাড়লেও কাজের কাজ হচ্ছিল না। ৬৪তম স্পেনের তিন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সের কাছ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট এক শট নেন জুড বেলিংহ্যাম।
দুই মিনিট বাদেই আবার ইংলিশদের বুকে কাঁপন ধরান স্প্যানিশ ওয়ান্ডারবয় লামিন ইয়ামাল। ৬৬ মিনিটে ড্যানি ওলমোর থ্রু বল ধরে ইংলিশ ডি বক্সের ডানদিক থেকে দারুণ এক শট নেন ইয়ামাল। কিন্তু দুর্দান্ত এক সেইভ দেন জর্ডান পিকফোর্ড। ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়ামালের শটটাকে বাইরে পাঠিয়ে দেন ইংলিশ গোলরক্ষক।
আক্রমণে গতি আনতে ৭০তম মিনিটে আরও এক পরিবর্তন আনেন গ্যারেথ সাউথগেট। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কোবি মেইনুকে তুলে নিয়ে মাঠে পাঠান আরেক তরুণ প্রতিভা কোল পালমারকে। ফলও ধরা দেয় হাতেনাতে। ৭৩তম বেলিংহ্যাম বক্সের মধ্যে বল পেয়ে সেটি কৌশলে দিয়ে দেন বাইরে অপেক্ষমান পালমারের কাছে। আর তা থেকেই বাঁ পায়ের দূরপাল্লার শটে চোখ ধাঁধানো এক গোল করেন চেলসির উইঙ্গার।
তবে এই সমতা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি সাউথগেট শিষ্যরা। ৮২তম মিনিটে ইয়ামালের আরেকটি শট ঠেকিয়ে দিলেও ৮৬তম মিনিটে এসে দ্বিতীয়বারের মতো পরাস্ত হন ইংলিশ গোলরক্ষক পিকফোর্ড। মার্ক কুকোরেলার ক্রস থেকে বক্সের মধ্যে বল পেয়ে জালে ঢুকিয়ে দেন বদলি হিসেবে নামা মিকেল ওয়ারজাবাল।
ম্যাচের শেষ মূহূর্তে এসে দারুণ এক সুযোগ তৈরি করেছিল ইংলিশরা। ৯০তম মিনিটে কোল পালমারের কর্ণার কিকটি বক্সের মধ্যে উড়ে এলে তাতে শক্ত হেড করেন ডেকলান রাইস। কিন্তু সেটি ঠেকিয়ে দেন স্পেনের গোলরক্ষক উনাই সিমন। তখনও স্পেনের বিপদ কাটেনি। ফিরতি বলে আবার হেড করেন মার্ক গুয়েহি। এবার গোলমুখে দাঁড়িয়ে সেটি হেডে আটকে দেন ড্যানি ওলমো। ফিরতি বলে আবারও হেড করেন রাইস। কিন্তু সেটি চলে যায় গোলবারের সামান্য উপর দিয়ে। নিশ্চিত এক গোল থেকে বঞ্চিত হয় ব্রিটিশরা। সেইসঙ্গে ভেঙে যায় তাদের প্রথম ইউরো শিরোপা জয়ের স্বপ্নও। ৫৮ বছরের শিরোপা খরা দীর্ঘ হয় আরও।
ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো স্প্যানিশ স্কোয়াড আর গ্যালারিভর্তি সমর্থক। ইউরো ফুটবলের একক অধিপতি তারা এখন।
বিএ…